কথাবার্তায়: নিজের কাজের ঘরে অজয়। দার্জিলিঙে। নিজস্ব চিত্র।
আনন্দবাজার: দীর্ঘদিন পাহাড় নানা ভাবে অস্থির থেকেছে। এর ফলে ব্যবসারও ক্ষতি হয়েছে।
অজয়: হ্যাঁ। আমার এখানেও হামলা হয়েছে। ইট ছোড়া হয়েছে। আমি দীর্ঘদিন শিলিগুড়িতে ছিলাম। এখন কথা হচ্ছে, গোর্খাল্যান্ড তো আমাদের হৃদয়ে (বুকের বাঁ দিকে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেন)। সেই নিয়ে যদি আমরা চুপ করে যাই, সেই ইস্যু যদি ছেড়ে দিই, আমরা পাহাড়ের মানুষের কাছে গুরুত্ব হারাব। তা নিয়ে তো চুপ থাকা যায় না। কিন্তু যে পরিস্থিতি পাহাড় দেখেছে এর আগে, তা আর পাহাড়ের মানুষ চান না। এই বন্ধ, এই রক্তক্ষয়। বন্ধের ফলে রোজগারের ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। আমি আগেই বলেছিলাম, আমরা ক্ষমতায় এলে দার্জিলিংকে বন্ধ-মুক্ত এলাকা করব। এ বারে আমরা সেটাই করতে চাই। আমরা চাই, এখানে ব্যবসায়ীরা আসুন এবং নির্ভয়ে ব্যবসা করুন।
আনন্দবাজার: তা হলে আন্দোলন?
অজয়: আন্দোলনের সেই দিনগুলির কথা সাধারণ মানুষ পিছনে ফেলে আসতে চান। চে গেভারা, ফিদেল কাস্ত্রোর মতো রোম্যান্টিক সশস্ত্র আন্দোলনের দিন এখন আর এখানে নেই। কারণ, সাধারণ মানুষ দেখেছেন, সেই আন্দোলন আখেরে কোনও লাভ হয়নি। পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে যে আন্দোলন, তা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটা হয়তো আমার জীবদ্দশায় ঘটবে না। কিন্তু এর জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের এই দাবির জন্য সহানুভূতি অর্জন করতে হবে। গোর্খাল্যান্ডের জন্য সহানুভূতি শুধু হিল স্টেশনে থাকলেই হবে না। শিলিগুড়ি গেলেই সেই সহানুভূতি উবে যায়। আমি লস অ্যাঞ্জেলেস গিয়ে দেখেছি, সেখানে দেখেছি, প্ল্যাকার্ড নিয়ে লোকজন আন্দোলন করছেন— ‘ফ্রি টিবেট’।
আনন্দবাজার: তারা এই আন্দোলন এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।
অজয়: তারা এখনও অহিংস ভাবে সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও এই ভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের বাঙালিদের মধ্যেও নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। আমি চা বাগানের শ্রমিকদের একটা দিনের জীবনযাত্রার উপরে তথ্যচিত্র তৈরি করাতে চাই। কী ভাবে সেই মহিলা সকালে উঠে নিজের বাচ্চাদের খাইয়েদাইয়ে, গামবুট পরে বৃষ্টির দিনে গিয়ে চা তুলছেন এবং দিনের শেষে পাচ্ছেন কত? ১৮০ টাকা। সবাইকে সেটা জানতে হবে। কলকাতার কবি-গীতিকারেরা হয়তো এক দিন এই ভাবে দার্জিলিঙের জন্য ন্যায় চাইবেন। হয়তো আমার জীবদ্দশায় নয়, তার পরে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারবেন আমরা যা চাই তা বাংলা বা বাঙালির বিরুদ্ধে নয়। এটা হতে সময় লাগবে। আমার সন্তানেরা এই আন্দোলন বহন করে নিয়ে যাবে। তিব্বতের মতো। কিন্তু হিংসা নয়। এখন বিমল, অনীত, বিনয় ভিআইপি গাড়িতে চড়ে বেড়ান। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে এখনও তাঁদের দলের লোকজন জেলে বন্দি রয়েছেন। আমি এমন একজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম, যিনি পাঁচ বছর ধরে মিথ্যে মামলায় বন্দি। তাঁর স্ত্রীর ডায়াবেটিস আছে। খুব অসুস্থ। তিনি আমাকে দেখে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, আমাদের তো দোষ ছিল না। আমি বললাম, যত দিন আপনার স্বামী জেলে থাকবেন আমি আপনার পরিবারকে দেখব। আমাদের দলে এমনটা হতে দেব না।
শাসকের সঙ্গে জোট নয়
আনন্দবাজার: আপনি যা বলছেন, তার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তা কিছু ক্ষেত্রে মেলে। উনি তো আসছেন ২৭ মার্চ। আপনি কি ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন বলে ভেবে রেখেছেন?
অজয়: দেখুন উনি যদি অ্যাপয়ন্টেমেন্ট দেন, তা হলে পুরসভার চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের উচিত ওঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করা। রাজনৈতিক ভাবে যদি বলি, (রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে) জোট করাটা সব সময়ই খারাপ চিন্তাভাবনা। পাহাড়ের লোকজনের যদি মনে হয়, পাহাড়ের নেতারা রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে সমঝোতায় রয়েছেন, তা হলে পাহাড়ের সেই নেতা ভোটে হারবেন। মন ঘিসিং তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা করে পাহাড়ের সব পুরসভা মিলিয়ে ৮৪টা ওয়ার্ডের একটাতেও জিততে পারেননি। তার পরে বিনয় তামাং জোট করলেন তৃণমূলের সঙ্গে। উপনির্বাচনে নিজের বুথে হেরে গেলেন। ২০১৯-এর বিমল গুরুং আলাদা ছিলেন। এক ভিডিয়ো করে তিনি হিরো হয়ে যেতেন। রাজু বিস্তার সময়ে। আমি তখন ওঁকে বলেছিলাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু অডিয়ো বার্তা দিন। আমরা রাজু বিস্তাকে জিতিয়ে দেব। সেটাই হয়েছিল। আর এখন ২০২২-এর বিমল গুরুংকে দেখুন। তাই রাজনৈতিক ভাবে রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে যাওয়া অর্থহীন। আমাদের লোকজন বিভিন্ন আন্দোলনে মারা গিয়েছে, পাহাড়ের মানুষ সে কথা ভোলেনি।
আনন্দবাজার: মাথার মধ্যে সেগুলি ঢুকে রয়েছে।
অজয়: ১৯৮৬ কমিউনিস্টদের আমলে যা ঘটেছিল, পাহাড়ের লোক ভোলেনি। ২০১৭ সালে তৃণমূলের আমলে যা হয়েছিল...। আমরা এখন পুরসভা দখল করেছি। এটা সরকারের অঙ্গ। তাই আমাদের রাজ্যের সঙ্গে ‘ডিপ্লোমেসি’ করতেই হবে। এতে আমি খারাপ কিছু দেখি না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী তো আমারও মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন কারণে আমার বিজেপির সঙ্গে সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, আমার পরিবারের লোকজন বিজেপিকে পছন্দ করে না। কারণ, আমরা খ্রিস্টান। কিন্তু আমাদের তো ডিপ্লোমেসি বজায় রাখতেই হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁদের পছন্দ না-ও করতে পারেন। আমার কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা আমাদের ভবিষ্যৎ নয়। আজ হামরো পার্টি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কারণ, বিমল, অনীত, বিনয় তৃণমূলের সঙ্গে। জিএনএলএফকে বিজেপির পুতুল মনে করা হচ্ছে। শুধু আমাদের কোনও ‘প্রভু’ নেই। আমরা কারও হাতের পুতুল হব না।
আনন্দবাজার: কিন্তু এটা তো স্থানীয় ভোটের কথা বললেন। লোকসভা ভোটে কী হবে?
অজয়: আমাদের কারও না কারও সঙ্গে জোট করতে হবে।
আনন্দবাজার: কিন্তু কাদের সঙ্গে?
অজয়: কাদের সঙ্গে! কারণ, শুধু দার্জিলিঙের ভোট একশো ভাগ পেলেও হবে না। সমতলের বিধানসভা কেন্দ্রগুলি রয়েছে। তাই লোকসভায় আমাদের কারও সঙ্গে সমঝোতা করতেই হবে। তবে বিজেপির এখন দার্জিলিঙে হাল ভাল নয়। কারণ, গত ১৩ বছরে তারা কোনও কাজ করেনি।