জল-জঞ্জালের যন্ত্রণাই হাতিয়ার ভোটে

পিচের রাস্তা ছিল হাতে গোনা। হিলকার্ট রোড, বিধান রোডে দ্বিমুখি যান চলাচলের ব্যবস্থাও ছিল না। পানীয় জল সরবরাহের আধুনিক কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। নলকূপ, সরকারি কুঁয়োই ভরসা ছিল। সুষ্ঠু জলনিকাশি ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কাঁচা নর্দমা দিয়েই জল গিয়ে পড়ত জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী, সাহু ও মহানন্দা নদীতে। শহরে তেমন আবর্জনাও জমত না। কয়েক দশক আগেও শিলিগুড়ি পুরসভার জল-জঞ্জালের ছবিটা ছিল এমনই।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০১:৪৩
Share:

শিলিগুড়িতে পানীয় জলের জন্য অপেক্ষা। —নিজস্ব চিত্র।

পিচের রাস্তা ছিল হাতে গোনা। হিলকার্ট রোড, বিধান রোডে দ্বিমুখি যান চলাচলের ব্যবস্থাও ছিল না। পানীয় জল সরবরাহের আধুনিক কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। নলকূপ, সরকারি কুঁয়োই ভরসা ছিল। সুষ্ঠু জলনিকাশি ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কাঁচা নর্দমা দিয়েই জল গিয়ে পড়ত জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী, সাহু ও মহানন্দা নদীতে। শহরে তেমন আবর্জনাও জমত না। কয়েক দশক আগেও শিলিগুড়ি পুরসভার জল-জঞ্জালের ছবিটা ছিল এমনই।

Advertisement

পুরসভা গঠনের পরে ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাতে থাকে। নলবাহিত পানীয় জল প্রকল্পের সূত্রপাত হয়। বাড়তে থাকে জনবসতি। ক্রমশ জঞ্জালও বাড়তে থাকে শহরে। ঘিঞ্জি হতে তাকে বহু এলাকা। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের আশ্রয়ের জন্য একের পর এক কলোনি গড়ে ওঠে শহরে। অতীতের সেই পুরসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পানীয় জলের সমস্যা, জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজ করাতে যে হিমশিম খেতেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

ধীরে ধীরে শহর আরও বেড়েছে। শিলিগুড়ি পুরসভা কর্পোরেশন হয়েছে। ৪৭টি ওয়ার্ডে জনবসতি কয়েক লক্ষ ছাড়িয়েছে। দৈনিক গড়ে জঞ্জালের পরিমাণ ৩০০ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। ফুলবাড়িতে পানীয় জলের প্রকল্প হয়েছে। কিন্তু, সেখান থেকে সংযোজিত এলাকার সর্বত্র সুষ্ঠুভাবে জল সরবরাহ হয় না। সম্বত্‌সরই সংযোজিত এলাকার বাসিন্দারা জলকষ্টে ভোগেন। শহরের কেন্দ্রস্থলেও জলের চাপ অনেক সময়েই কম থাকে। পুরসভার ইঞ্জিনিয়রদের একাংশের আশঙ্কা, যে ভাবে শহরে বিনা অনুমতিতে নানা এলাকায় পাম্প বসিয়ে প্রোমোটারদের একাংশ জল তোলার ব্যবস্থা করে চলেছে তাতে বিপদের সম্ভাবনা বাড়ছে। এতে জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে কমছে বলে তাঁদের ধারণা।

Advertisement

শিলিগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময়ে শহরের জল-জঞ্জালের সমস্যার সমাধানে কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেন। পরে পুরমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর উদ্যোগে শহরে অনেক কাজও হয়েছে বলে বামেদের দাবি। শহরের পানীয় জল সরবরাহের আধুনিকীকরণ কিংবা জঞ্জাল সাফাইয়ের অত্যাধুপনিক ব্যবস্থার সূচনাও তাঁর উদ্যোগে হয়েছিল বলে বামেদের দাবি। ঘটনাচক্রে, শহরে নদী দখল করে বসতি বেড়ে যাওয়া, ফুটপাত দখল করে ব্যবসা, মহানন্দায় খাটালের রমরমাও কিন্তু বাম আমলেই শুরু হয়েছিল বলে অভিযোগ।

তবে বামেদের হটিয়ে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট শিলিগুড়ি পুরবোর্ড দখলের পরে রাস্তা, নদী দখলের প্রবণতা কমার তুলনায় বেড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। খাটাল উচ্ছেদের জন্য অভিযানও সেভাবে হয়নি। হয়নি সব ওয়ার্ডে সমান ভাবে পানীয় জল সরবরাহের কাজও। অশোকবাবুর কথায়, “অনেক কাজ বাম আমলে হয়েছে। তার ধারাবাহিকতা না থাকায় মানুষের সমস্যা বেড়েছে। সেই থমকে থাকা উন্নয়ন আবার জোরকদমে করতে হবে। আমরাই সেটা করব।”

গত গ্রীষ্মেই দীর্ঘদিন পানীয় জলের কষ্ট সইতে হয়েছে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের। পুজোর পরেও কয়েকটি ওয়ার্ডে পানীয় জল মেলেনি দীর্ঘদিন। তাই এ বারের পুরভোটে শহরের পানীয় জলের সমস্যাকে হাতিয়ার করতে আসরে নেমেছেন বিজেপির অনেকেই। বিজেপি’র ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী দীপায়ন বিশ্বাস বলেন, “পুরসভার সংযোজিত এলাকায় আমাদের ওয়ার্ডেও পানীয় জলের সমস্যা তীব্র। পর্যাপ্ত ট্যাপকল নেই। তা ছাড়া জল সরবরাহ অনিয়মিত। অনেক সময় সরু সুতোর মতো ধারায় জল পড়ে। মাঝে মধ্যে জল সরবরাহ বন্ধও থাকে। বাসিন্দাদের ৩-৪ কিলোমিটার দূরে অন্য ওয়ার্ডে গিয়ে জল আনতে হয়। আশেপাশের অনেক ওয়ার্ডেই ওই সমস্যা রয়েছে বলে চেনা পরিচিতেরা প্রায়ই বলেন।”

শিলিগুড়ি পুরসভার অন্যতম প্রবীণ কাউন্সিলর প্রতুল চক্রবর্তী বহু বছর বাদে ফের পুরভোটে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি। প্রতুলবাবু ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাম আমলের পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান রবিন পালকে হারিয়ে সেই সময়ে দলে সমাদৃত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত থাকায় দাঁড়াতে পারেননি। পের এবার প্রার্থী হয়ে প্রতুলবাবুর ঘোষণা, “শিলিগুড়ির জল-জঞ্জালের সমস্যার সমাধান অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। ফুলেশ্বরী, জোড়াপানির মতো নদীর হাল ফেরাতে আমরা বদ্ধপরিকর।”

গত ৫ বছর কয়েক দফায় পুরসভার মেয়র পারিষদ ছিলেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী সুজয় ঘটক। তিনি পরিবেশ, পূর্ত, সাফাই বিভাগ সামলেছেন। কংগ্রেস সূত্রের দাবি, তাঁর উদ্যোগেই শহরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছিল পুরসভা। তবে পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরানোর কয়েক মাস আগে আচমকা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বিরোধী অভিযান স্তিমিত হয়ে যায়। সুজয়বাবুর অভিযোগ, “পানীয় জলের সমস্যা অনেকটাই দূর করা গিয়েছিল। জঞ্জাল সাফাইয়ের পরিকাঠামোর আধুনিক করার জন্য প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছিল। শহরের রাস্তায় জলও দেওয়া হচ্ছিল। নানা সমস্যায় সব কাজ করা যায়নি। সে সবই শহরবাসী জানেন। তা ফের আমরা শহরবাসীর সামনে তুলে ধরব।”

পুরভোটের প্রাক্কালে জল-জঞ্জাল নিয়ে এমন চাপানউতোর অবশ্য নতুন কিছু নয়। নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঠেলাঠেলির রসদ আরও অনেক কিছুই রয়েছে।

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement