রানা হোসেন (বাঁ দিকে), রাইহান আলি (ডান দিকে) —নিজস্ব চিত্র।
এক জন রঙের কাজ করে। অন্য জন দিনমজুরি। তবে দিন শেষে বিকেলটুকু একান্তই তাদের নিজেদের। সে সময়ে চলে তাদের প্রশিক্ষণ। কখনও দৌড়, কখনও লাফানো, আবার কখনও শরীরচর্চা। সারা দিনের শ্রান্তিতে শরীর ভেঙে এলেও, থামার পাত্র নয় রানা ও রাইহান। এই একগুঁয়েমি আর পরিশ্রমই তাদের এনে দিয়েছে মাদ্রাসা রাজ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্বর্ণ পদক।
কোচবিহারের ধাইয়ের হাট হাই মাদ্রাসার ছাত্র ওই দু’জন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি মালদহ ও মুর্শিদাবাদে মাদ্রাসা বোর্ডের রাজ্য স্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়। ওই প্রতিযোগিতায় রানা হোসেন দু’শো মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছে। আর রাইহান আলি লং জাম্পে প্রথম হয়েছে। দুই ছাত্রের কথায়, “পড়াশুনো ও খেলা দুই বিষয়েই আরও এগিয়ে যেতে চাই। জানি না পারব কি না! তবে চেষ্টা করে যাব।” ধাইয়ের হাই মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হামিদুল ইসলাম বলেন, “রানা ও রাইহান দু’জনই ভাল ছাত্র ও ভাল খেলোয়াড়। কিন্তু আর্থিক অনটন তাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সব সময় তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’’ শুধু খেলা নয়, পড়াশোনাতেও আগ্রহ রয়েছে এই দু’জনের। রানা বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হতে চায়। রাইহান যেতে চায় সেনাবাহিনীতে। সংসারে অভাব আছে দু’জনেরই। তবে দুই লড়াকু ছেলেরই জেদ, সেই অভাব পেরিয়ে এক দিন লক্ষ্যে পৌঁছবে তারা।
কোচবিহারের পানিশালা এলাকায় বাড়ি রানা ও রাইহানের। বাড়ি বলতে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ঘর। রানারা তিন ভাইবোন। দিদি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। তাঁর বিয়েও হয়ে গিয়েছে। ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী। রানা মাধ্যমিকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। এ বার সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সে জন্য দু’জন শিক্ষকের কাছে পড়ে সে। তার বাবা জাকির হোসেন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কোনও দিন কাজ থাকে, কোনও দিন থাকে না। সংসার চালাতে হিমশিম হাল। তাই বাবাকে সাহায্য করতে রঙের কাজ করে রানা। নিজের পড়াশোনা নিজেই চালায়। তার পরে সংসারেও কিছু টাকা দেয়। জাকির বলেন, “ছেলের লক্ষ্য অনেক বড়। আমিও চাই, ও পড়াশুনো, খেলাধুলা করুক। জানি না, কতটা পারব!”
একাদশ শ্রেণির রাইহানের পরিবারের হালও তথৈবচ। পড়াশুনোর ফাঁকে রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করতে হয় তাকে। বাবা মজিদুল হক হাটে-হাটে আনাজ বিক্রি করেন। সে টাকায় সংসার চালানো কঠিন। তাই বাবার পাশে দাঁড়াতে নিজেই কাজে নেমেছে রাইহান। তাঁর ছোট ভাই সোহেল সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। রাইহানের কথায়, “সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। প্রাইভেট টিউশন পড়ার মতো টাকা কই! আমার ইচ্ছে, সেনাবাহিনীতে চাকরি করার। সে লক্ষ্য পূরণের চেষ্টাও করছি।” রাইহানের বাবা মজিদুলের আক্ষেপ, “ছেলেটা খেলায় খুব ভাল। পড়াশুনোতেও খারাপ নয়। কিন্তু তাকে সহযোগিতা করতে পারছি কোথায়? সাহায্য পেলে হয়তো ও অনেক দূর যেতে পারত।’’