জলপাইগুড়ি আদালতে ধৃত হামিদুল আলি (বাঁ দিকে)। ধূপগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান অরূপ দে, যাঁর বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে রফার প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ছবি: সন্দীপ পাল, নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের ডাকা সালিশি সভা থেকে উধাও দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় শাসক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভূমিকা নিয়ে আরও গুরুতর অভিযোগ উঠল বৃহস্পতিবার। প্রশ্ন উঠল, পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।
নিহত ছাত্রীর বাবা-মায়ের অভিযোগ, দেহ মেলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এলাকার তৃণমূল নেতা তথা ধূপগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান অরূপ দে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে ‘রফা’র প্রস্তাব দেন। পরামর্শ দেন, মামলা করার দরকার নেই। ছাত্রীটির বাবা-মা তাতে রাজি না-হয়ে ধূপগুড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে সেখানে তাঁদের আর এক দফা চাপের মুখে পড়তে হয়। মেয়েটির বাবা-মায়ের অভিযোগ, পুলিশের কয়েক জন তাঁদের বলেন, অভিযোগে সালিশি সভার বিষয়টি উল্লেখ করার দরকার নেই। এমনকী তাঁদের জিআরপি থানায় যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। ধূপগুড়ি থানা শেষ পর্যন্ত অভিযোগ জমা নিলেও তার পর থেকে তাঁদের নানা রকম চাপ এবং হেনস্থা সহ্য করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ওই ছাত্রীর মায়ের। বুধবার রাতে ওই ঘটনায় তহিরুল রহমান এবং হামিদুর আলি নামে দু’জনকে ধরেছে পুলিশ। তবে মূল অভিযুক্তরা এখনও অধরাই।
স্থানীয় বহু মানুষ পাশে দাঁড়ানোয় সাহস পেয়ে নিহতের বাড়ির লোকেরা বৃহস্পতিবার কিছুটা খোলাখুলি কথা বলেন। ছাত্রীটির মায়ের অভিযোগ, “আমরা তখন মেয়েটার শোকে মরছি। ভাইস চেয়ারম্যান অরূপ দে এসে বাড়িতে ঢুকলেন। প্রথমে দুঃখপ্রকাশ করলেন। এর পরে মোটা টাকা দিতে চাইলেন! মামলা-মোকদ্দমা থেকে দূরে থাকার পরামর্শও দেন। মেয়েটাকে যারা ছিঁড়ে খেয়েছে, টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেব?”
তৃণমূল নেতা অরূপবাবু এখন ‘কাজের’ জন্য মুম্বই-এ। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, মেয়েটির দেহ উদ্ধারের পরেই তার বাড়িতে তিনি গিয়েছিলেন। অরূপবাবুর দাবি, “সমবেদনা জানাতে ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। টাকার প্রলোভন দিইনি।” পুরসভার চেয়ারম্যান শৈলেন রায়ের দাবি, “ওই পরিবার দরিদ্র, সে জন্যই অরূপবাবু স্থানীয় কয়েক জনকে নিয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে অর্থসাহায্যের কথা বলেন। এখন তা নিয়ে জলঘোলা করা হচ্ছে।”
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ছাত্রীটি সালিশির প্রতিবাদ করায় সেখানে উপস্থিত তৃণমূল কাউন্সিলর নমিতা রায়, তাঁর স্বামী চন্দ্রকান্ত এবং তাঁদের সমর্থকরা ওই ছাত্রীকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিলেন। একটি পাম্প সেটের বকেয়া ভাড়া নিয়ে তৃণমূল কাউন্সিলরের ডাকা সালিশি সভায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ওই ছাত্রীটি এবং তার ভাই-বোনকেও জোর করে হাজির করান স্থানীয় তৃণমূল কর্মী তহিদুল ইসলাম-সহ কয়েক জন। সভায় ওই ছাত্রীর বাবাকে গালিগালাজ করে তখনই চার হাজার টাকা জরিমানা দিতে বলা হয়। তিনি বিশ্বকর্মা পুজোর পরে টাকা মিটিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তখন তাঁকে মারধর করেন চন্দ্রকান্তবাবুর অনুগামীরা। সে সময় ওই ছাত্রী এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের বয়ান অনুযায়ী, ওই ছাত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘এটা বিচারের নামে নাটক হচ্ছে।
আপনারা আইন নিজের হাতে নিতে পারেন না। এক পক্ষের কথা শুনে যা খুশি করবেন, তা হয় না। দেশ থেকে আইন উঠে যায়নি’।
ছাত্রীটির বাবার অভিযোগ, এর পরেই তাঁর মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে মারধর করেন ওই পাম্পসেট মালিকের স্ত্রী। তাতে যোগ দেন সালিশি সভায় উপস্থিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কয়েক জনও। মারধরের পরেও ওই ছাত্রী দমেনি। তখন সভায় উপস্থিত কয়েক জন ওই ছাত্রীকে থুতু ফেলে চাটানোর ‘ফতোয়া’ দেন। ধস্তাধস্তির মধ্যে ওই ছাত্রী ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। সে বাড়ির দিকে ছুটলে তার ছোট বোনও পিছু নেয়। তখন সালিশি সভায় তাদের বাবাকে আটকে রেখে তাদের মা-কে নির্দেশ দেওয়া হয়, মেয়েকে খুঁজে এনে সভায় থুতু ফেলে চাটালে রেহাই মিলবে।
ওই কিশোরীর মা বলেন, “মেয়ে থুতু চাটবে না জানিয়ে ছুটে পালায়। বাড়িতে তালা দেওয়া ছিল বলে মেয়েরা ঢুকতে পারেনি। ছোট মেয়েকে পাশের বাড়ির গোয়ালঘরে পাই। বড় মেয়ের চটি জোড়া পেলেও তাকে খুঁজে পাইনি। বহু আবেদনের পরে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ সালিশি সভা থেকে ছাড়া পাই।” রাত আড়াইটে অবধি নানা জায়গায় খুঁজেও মেয়ের হদিস মেলেনি। ভোর হলে আশেপাশের গাঁয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে খুঁজবেন ভেবেছিলেন। তার আগেই রেললাইনের কাছে মেয়ের দেহ মেলে।
পরিবারের অভিযোগ, এর পরেই তৃণমূল নেতাদের একাংশ মামলা না করার জন্য চাপ বাড়াতে থাকেন। সালিশি সভার উল্লেখ না করার জন্য পুলিশও বারবার বলে। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, কাউন্সিলর নমিতাদেবীর কাছে আসা অভিযোগ নিয়ে প্রায়ই সালিশি সভা বসান চন্দ্রকান্তবাবু। সেখানে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা যা বলেন, সেটাই শেষ কথা। যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, যে তিন জনকে ধরা হয়েছে, তাদের গ্রেফতারির নথিতে সালিশি সভার উল্লেখ নেই। শিলিগুড়ি রেল পুলিশের সুপার দেবাশিস সরকারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, “মামলা সবে শুরু হয়েছে। তদন্তে সব আসবে।”
তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী গোড়া থেকেই দাবি করছেন, ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যা। কিন্তু তা মানতে নারাজ অনেকেই। মেয়েটির দেহ মিলেছিল রেললাইনের ধারে। সাধারণত, লাইনে দেহ মিললে ট্রেনের চালকরা সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। সূত্রের খবর, পুলিশ কোনও ট্রেনের চালকের কাছ থেকে সে দিন রাতে কেউ ঝাঁপ দিয়েছে বলে এখনও জানতে পারেনি।
রেল পুলিশ সূত্রের খবর, লাইনের মধ্যে ওই ছাত্রীর বাঁ হাতটি পড়ে ছিল। বাকি দেহ খণ্ড খণ্ড অবস্থায় লাইন থেকে ৭-৮ মিটার দূরে পড়ে ছিল। রেল পুলিশের এক প্রাক্তন অফিসার জানান, কেউ ঝাঁপ দিলে ট্রেনের চালক দেখতে পাবেনই। ঝাঁপ দিলে শুধু বাঁ হাত কাটা যাবে কেন, সেটাও দেখা জরুরি। এই অবস্থায় আজ, শুক্রবার ফরেন্সিকের দল ঘটনাস্থলে যাচ্ছে।
নিহত ছাত্রীর স্কুল-সহ ধূপগুড়ির অপর একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এ দিন এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল করে। জেলা কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল মৃতার বাড়ি যায়। অন্য দিকে, তৃণমূলের তরফে ‘মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলে মিছিল করা হয় ধূপগুড়িতে।
ওই ছাত্রী যে স্কুলে পড়ত, সেই বিদ্যাশ্রম দিব্যজ্যোতি হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, “প্রথমে আমাদের বলা হয়েছিল, পারিবারিক বিবাদের কারণে ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। মঙ্গলবার তাই শোকসভা করে স্কুল ছুটি দেওয়া হয়। বুধবার আমরা শিক্ষকরা তার বাড়িতে গিয়ে পুরো ঘটনা জানি। সেখানে ঠিক হয়, আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে আমাদের পথে নামতে হবে। সেই অনুযায়ী আমরা ও ছাত্রছাত্রীরা সকলে থানায় গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে আসি।” সাত দিনের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা না হলে ফের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষকরা ধূপগুড়ি থানায় জড়ো হবেন বলে জানান তিনি। ওই ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আজ শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানও বাতিল করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
মেয়েটির বাবা-মা বলেন, “মেয়েকে হারিয়েছি। এখন সুবিচার পাওয়ার জন্য দিন গুনছি।”