সঙ্গে: সহকর্মীদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা মিশা ঘোষাল। নিজস্ব চিত্র
১৯৮০ সালে রাশিয়ায় যে অলিম্পিক্স হয়েছিল, তার ম্যাসকট ছিল ভালুক মিশা। সেই ভালুকের নামেই মেয়ের নাম রেখেছিলেন মিশার বাবা। রুশ ভাষায় যার অর্থ, যিনি ঈশ্বরের মতো। আলিপুরদুয়ার জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় টোটোপাড়া ধনপতি মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিশা ঘোষালও যেন এখানকার লোকজনের কাছে আশীর্বাদ হয়েই এসেছিলেন বারো বছর আগে। সেখানকারই কেউ কেউ বলছেন, ‘‘তখন তো অত বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন দেখছি। উনি স্কুলটাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন।’’ আর সেই স্কুলকে সামনে রেখে গোটা এলাকা এখন এগিয়ে যাওয়ার লড়াই করছে।
এ বছরের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন মিশাদেবী। অথচ ২০০৮ সালে যখন টোটোপাড়ার এই স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষিকা হয়ে এসেছিলেন, তখন স্কুলের ক্লাসঘরে তালা পড়ে যেত শেষ বাস ছাড়ার আগে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছুটতেন বাস ধরতে। কেন? কারণ, মাদারিহাট থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকার এই স্কুল থেকে আর কোনও উপায় ছিল না। মিশাদেবী স্কুলের সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ টোটোর সহযোগিতায় বদলে ফেলেন স্কুলের সময়। এখন ১১টা থেকে চারটে অবধি হয় স্কুল। শিক্ষকরাও পুরো সময় থাকেন। ক্লাস হচ্ছে দেখে আগ্রহ বাড়ছে পড়ুয়াদের। ফলে যে স্কুলে কোনও বছর এক জনও পাশ করত না, সেখানে এখন পড়াশোনা চলছে পুরোদমে। মিশাদেবী অক্লান্ত চেষ্টায় স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষকের অভাবে তা দু’বছর ধরে চালু হতে পারেনি। তবে এ বছর শিক্ষকও দেওয়া হবে বলে আশ্বাস মিলেছে।
এই টোটোপাড়ায় ১৫৮০ জন টোটো বাস করেন। মোট ৩৫০টি ঘর। মাদারিহাট থেকে যেতেই পার হতে হয় তিতি, হাউরি, বাংরি, কালিখোলার মতো আটটি পাহাড়ি ঝোরা। স্কুলের সামনে দাঁড়ালে পিছনে ভুটান পাহাড়। ঘরগুলি এখনও বেহাল। সংস্কার প্রয়োজন। মিশাদেবী মেনে নিলেন, শিক্ষকের ঘাটতিও পূরণ হওয়া দরকার। কিন্তু সবার আগে দরকার ছিল নিয়মিত পড়াশোনা। সেটা চালু হয়েছে পুরোদমে।
মিশা বলেন, ‘‘অঞ্জু টোটো নামে একটি মেয়ে পড়ত এই স্কুলে। নবম শ্রেণিতে উঠার পর থেকে আর স্কুলে আসছিল না। একদিন স্কুল ছুটির পর ওদের বাড়ি গেলাম। কথা বললাম ওর মা-বাবার সঙ্গে। বাড়ির কাজকর্মের জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। অঞ্জু এবং ওর মা-বাবাকে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কুলে আনতে পেরেছিলাম। দু'বছর পরে অঞ্জু ভাল নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করে। কিন্তু স্কুল তখনও উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত না হওয়ায় অঞ্জুর আর পড়া এগোল না। এ বারে উচ্চ মাধ্যমিক চালু হলে আশা করি এই অবস্থা বদলাবে।’’
টোটো জনজাতিদের নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। বলেন, ‘‘টোটোদের আর্থ-সামাজিক বিকাশ ঘটাতে হলে শিক্ষার বিকাশ ঘটানো সাবার আগে জরুরি।’’ স্কুলটিকে যাতে বিশেষ স্কুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেই আর্জিই জানাবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। এলাকার বাসিন্দা অশোক টোটো বলেন, ‘‘স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার পাওয়ায় আমরা গর্বিত। আমরা চাই স্কুলের উন্নতি, শিক্ষার বিকাশ।’’