পড়াশোনা: ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। নিজস্ব চিত্র
আগের দিন বাড়ি এসে শিক্ষকরা বলে গিয়েছিলেন, আজ থেকে ক্লাস শুরু হবে! যদিও ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে যেতে হবে না। স্কুলই নাকি আসবে পড়ুয়াদের কাছে। মঙ্গলবার ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ন’টা। স্যারেরা এলেন। বোর্ড এল, চক এল। গাছগাছালির ছায়া খুঁজে পাতা হল পলিথিনের চাদর। সেখানে এক হাত দূরে দূরে বসানো হল পড়ুয়াদের। আম-জারুল-বট গাছ ঘেরা এক চিলতে ঘাসজমিই হয়ে গেল ক্লাসঘর। কে কোন স্কুলের সে সব বাছ-বিচার নেই। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়দের ডেকে নিয়ে বোর্ডে ছবি একে বোঝানো শুরু হল সূর্য আকাশের কোন দিকে থাকলে কোন দিকে ছায়া ফেলে। শিক্ষকেরা পড়াচ্ছেন, পড়ুয়ারা বোর্ডে ছবি দেখছে, সঙ্গে উপরে আকাশে তাকিয়ে সূর্য-ছায়া দেখছে। আশপাশে এক একটা গাছ দেখছে এবং পাঠ্য বই থেকে পড়ছে, ‘গাছেরা কেন চলাফেরা করে না?’
এ এক অন্য ক্লাসঘর! অন্যরকম স্কুল! লকডাউনের আগে থেকেই স্কুল বন্ধ। আড়াই মাস পার হয়ে তিন মাস হতে যাচ্ছে স্কুলের দরজায় তালা খোলে না। স্কুল থেকে চাল-আলু বিলি হলেও পড়ুয়াদের ডাকা হয়নি স্কুলে। অনলাইন ক্লাসের কথা রাজ্য-কেন্দ্র উভয় সরকার বললেও, একটিও অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি এমন এলাকার পড়ুয়াদের বেছে নিয়ে মঙ্গলবার থেকে অন্যরকম স্কুল শুরু হয়েছে জলপাইগুড়িতে। শহরের রাজবাড়ি এলাকার নীচ কলোনিতে সেই স্কুলে ক্লাস নিয়েছেন জনা পাঁচেক শিক্ষক। এলাকার বারো জন পড়ুয়াকে ডেকে আনা হয়েছিল ক্লাসে। ক্লাস বলতে এলাকার একটি ছায়াঘেরা উঠোন। সেখানে বোর্ড নিয়ে এসে পলিথিন বিছিয়ে ক্লাসের শুরু করানো হয়। এই ক্লাসের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রাথমিক শিক্ষক স্বপন বসাক। তিনি শিক্ষকদের একটি সংগঠনের নেতাও। তবে স্বপনবাবু এ দিন বলেন, “সংগঠনের নেতা হিসেবে নয় একজন শিক্ষক হিসেবেই ক্লাস নিয়েছি। রাজ্য সরকারও তো পড়ুয়াদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ করছে। যে এলাকাকে বেছে নিয়েছিলাম, সেটি পিছিয়ে পড়া।”
সামাজিক দূরত্ব মেনে কোনও এলাকায় গিয়ে ক্লাস শুরু করার এমন উদ্যোগ জলপাইগুড়িতে প্রথম বলে দাবি করা হয়েছে। এ দিনের ক্লাসে স্যানিটাইজ়ার-মাস্কের ব্যবহার নিয়েও কথা বলা হয়। পড়ুয়ারা সকলে মাস্ক পরেই পড়তে বসেছিলেন। সকালে দেড় ঘণ্টার ক্লাস হয়েছে। স্বপনবাবু বলেন, “এরপরে ক্লাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে। যে পড়ুয়ারা অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না তাদের জন্যই এই উদ্যোগ।”
যে মহল্লায় এ দিন ক্লাস হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের কেউ ভ্যান চালক, কেউ আনাজ বিক্রেতা। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে থাকায় চিন্তায় ছিলেন তাঁরাও। এক অভিভাবক বলেন, “মাস্টারমশাইরা নিজেরাই পড়াতে আসায় ভালই হল। ওদের তো বাড়িতেও পড়া দেখানোর তেমন কেউ নেই।”
কে কোনও স্কুলে পড়ে সে বাছাই ছিল না বলে ইউনিফর্ম পরে আসার বাধ্যবাধকতাও ছিল না। পিরিয়ড শুরু এবং শেষে ঘণ্টার শাসনও ছিল না।