রুটি রুজি: তিস্তা নদীতে মাছ ধরা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
ফি বছর পুজো চড়ে মাটির কুমিরের। সঙ্গে থাকে সওয়া কেজি নুন আর চিনি। পুজো সেরে তা জলে সঁপে দেন ফণী সরকারেরা। নদী পুজোর স্থানীয় রীতি। তিস্তায় কোনওদিন কুমির দেখা যায়নি বটে, তবুও স্থানীয়দের বিশ্বাস জলদেবতার সঙ্গে ঘড়িয়ালকেও তুষ্ট রাখা প্রয়োজন। ফণী বলেন, ‘‘পৌষ সংক্রান্তির দিন পুজো হয়। তা সেরে সাতদিন মাছ ধরা, নৌকাবিহার, পাখি দেখা সব বন্ধ। তারপর থেকে যা কিছু।’’ গজলডোবা থেকে সেবক, এই প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় তিস্তার পাশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় জনপদ। আর সেই মানুষগুলো রুটি-রুজির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে তিস্তার স্রোত।
গজলডোবায় তিস্তা ব্যারাজের পাশে রয়েছে মিলনপল্লি। সেখানকার বাসিন্দা ফণী সরকারের জীবনের তিন কুড়ি বছর গিয়েছে নদীর সঙ্গে সংসার করে। দক্ষ হাতে জাল ফেলে নদী থেকে মাছ তুলে আনেন ফণী। হাঁটু মুড়ে জাল গুছোতে গুছোতে আপন মনেই বলেন উঠলেন, ‘‘তিস্তা আর আগের মতো দরাজ নেই গো।’’ জানালেন, ডেগবা, চেলা, কাউলি, বোরলি-এরকমই কত নদীয়ালি মাছের ভিড় ছিল তিস্তায়। তার উপরেই সংসার চালাতেন অনেকে। বিক্রিবাটা করে নিজেদেও পেটেও যেত কিছু। এখন কমেছে মাছ, আর বাপ-দাদার জীবিকা ছেড়ে পেটের টানে যুবকেরা পাড়ি দিচ্ছেন দক্ষিণের রাজ্যে। ফণীর মতো অনেকেরই আক্ষেপ, ঘরের ছেলেরা শ্রমিক হয়ে রোজগার তো করছে কিন্তু ভুলে যাচ্ছে খেপলা জাল ফেলার কৌশল আর নদীর গায়ের গন্ধ। শুধু মৎস্যজীবী নয় ঘর ভেঙেছে চাষি পরিবারেরও। ‘ব্রিজ’ হওয়ার পরে মিলনপল্লির দিক থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে নদী। ফলে প্রভাব পড়েছে চাষেও। এলাকায় চাষবাসের উপর নির্ভরশীল কিছু মানুষ তিস্তার খাল, ‘চুলকানি নদী’র (খালের স্থানীয় নাম) জলে ভরসা করে বাদাম, কচু, পটল চাষ করে ব্যারাজের মুখে বাজারে বিক্রি করছেন। কিন্তু তাতে মিটছে না খিদে। কাজের সন্ধানে ঘর ছাড়ছেন চাষির ঘরের সন্তানও। গজলডোবায় ‘ভোরের আলো’ চালুর পরে ভিড় জমছে পর্যটকদের। তাঁদের নৌকায় ঘুরিয়ে দু’পয়সা আয় করেন এখানকার মানুষজন। কিন্তু অনেকসময়েই কুলোচ্ছে না তাতেও। বিকল্প পেশার খোঁজে নামতে হচ্ছে তাঁদেরও।
নদীও তো জীবন। তার এক এক মোড়ে এক এক ছবি। সেরকমই তিস্তার উজানেও বদলে যায় ছবি। সেখানে রোজগারের ভরসা হয়ে ওঠে বালি-পাথর। সেবকের একটু আগে তিস্তা থেকে বালি-পাথর ওঠানোর কারবার চলে। ওদলাবাড়ি, ভক্তিনগর, শালুগাড়া, মতো কয়েকটি এলাকার শ্রমিকদের একাংশের পেট চলে তিস্তার বালি-পাথরের উপরেই। তেমনই একজন ভক্তিনগর থানার লালটং বস্তির শ্রমিক ভানু থাপা। বালি-পাথর উঠিয়েই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ভানু। সংসারও টানছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তিস্তাই সব বাঁচিয়ে রেখেছে।’’ জীবনে ওঠাপাড়াও কম নয় ভানুদেরও। এলাকায় লালটং বস্তি থেকে শুরু করে সেবকের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় চর পড়েছে। পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, তিস্তায় একের পর বাঁধ দেওয়ায় জলের গতি কমেছে। সেবক- লালটং ছাড়িয়ে সমতলে নামার আগেই অনেক জায়গায় নদী ঘনঘন গতিপথে বদল আনছে। তাই নদীগর্ভের ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের তরফে বালিপাথর তোলার উপর বছরের নানা সময় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। আবার তার মধ্যেই চলে বেআইনি বালিপাথরের ব্যবসাও।
ওদলাবাডির বাসিন্দা শীলার দোকান তিস্তার আরও এক পর্যটনকেন্দ্র সেবক করোনেশন ব্রিজের একেবারে দোরগোডায়। শীলার কথায়, ‘‘পর্যটক আগের থেকে কমেছে। অনেকগুলেো নতুন পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে। তাতে সেবকের জৌলুস কমেছে।’’ এখানে পাহাড়ি রাস্তার একপাশে খাবার, রকমারি সামগ্রীর দোকানগুলোর ব্যবসা চলে ব্রিজ থেকে নদী দেখতে আসা পর্যটকদের উপর ভরসা করেই। রবিবার ব্যবসা একটু জমে সেবক বাজার, সেবকেশ্বরী কালিমন্দির আর করোনেশন
ব্রিজ ঘিরে।