সমব্যথী: কমিউনিটি কিচেনে। নিজস্ব চিত্র
বাড়িটার ভিতরে ব্যস্ততার শেষ নেই। কেউ চাল-আলুর প্যাকেট তৈরি করছেন। কেউ আনাজ কাটতে বসেছেন। টিন দিয়ে ঘেরা বাড়ির সামনের পাকা সড়ক থেকে চিৎকার শোনা গেল, “এটা কি সুমিদির কমিউনিটি কিচেন?’’ জবাব পেয়েই তিন জন ভিতরে ঢুকে পড়লেন। তাঁদের খাইয়ে-দাইয়ে হাতে একটা চালের পোটলা ধরিয়ে দিলেন সুমি। চোখ ছল ছল করছে তখন ওঁদের। একজন জড়িয়ে ধরলেন সুমিকে। বললেন, “দিদি, পাশে থেকো।’’ সুমি বললেন, “সব সময় থাকব। দরকার হলেই আমাকে ‘কল’ করবে।’’ একে একে আরও অনেকে এলেন সুমি দাসের ‘কমিউনিটি কিচেন’-এ। ওঁদের কেউ ট্রেনে ভিক্ষা করতেন, কেউ গান গাইতেন। আর পাঁচ জনের থেকে তাঁরা কিছুটা হলেও আলাদা।
সুমিও আর পাঁচ জনের মতো নন। কোচবিহারের ঘুঘুমারির মাথাভাঙা রোডে সুমির ঠিকানা। একসময়কার রূপান্তরকামী সুমি এখন রূপান্তরিত। ছোটবেলা থেকে নানা উপহাসের শিকার হয়েছেন। রাস্তায় বেরোলেই তাঁকে লক্ষ করে ছুটে আসত কটূক্তি। সুমি কিন্তু হাল ছাড়েননি। যাবতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে চারদিকে যখন লকডাউন চলছে, তখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও পড়েছেন একই সমস্যায়। কারও ঘরে খাবার নেই। কারও ওষুধের প্রয়োজন। সুমি কমিউনিটি কিচেন তৈরি করে এই বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধু কিচেন তৈরিই নয়, প্রয়োজনে টোটো ভাড়া করে জেলা জুড়ে সেই বাড়িগুলিতে পৌঁছে চাল-ডাল-আলু তুলে দিয়েছেন তিনি। সুমি জানান, তিনি লকডাউনের কয়েক দিন পর থেকেই ত্রাণ কাজে নেমে পড়েন। তাঁর ওই কাজে সহায়তা করেছেন বহু মানুষ। শুধু ওঁদের পাশেই নন, দিন কয়েক ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ত্রাণ বিলি করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাঁর কথায়, “মানুষ হয়ে মানুষের পাশেই থাকতে চাই।’’
তাঁরই মতো কোচবিহারের বহু তরুণ-তরুণী, প্রবীণ মানুষ লকডাউনে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা সাধারণ লোকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একাধিক ক্লাব, সামাজিক সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও দিন-রাত করে এক করে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষের বাড়িতে। ওই ত্রাণে শুধু চাল-ডাল নয়, শিশুখাদ্য, ওষুধপত্র সবই রয়েছে। কোচবিহারের এমনই একটি ক্লাবের সম্পাদক অভিষেক সিংহ রায় জানান, তাঁরা চাল-ডাল তো বটেই, ডিম, দুধের প্যাকেট, এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিনও পৌঁছে দিয়েছেন গরিব বাসিন্দাদের হাতে। তিন দিন কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ এবং চ্যাংরাবান্ধায় যৌনপল্লির বাসিন্দাদের ডিম-ভাতও খাইয়েছেন। এমন খাবার নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সামাজিক সংস্থার অন্যতম সদস্য অনুপম পাল জানান, তাঁরা নিয়ম করে হাসপাতাল তো বটেই, যৌনপল্লির শিশুদের জন্য আলাদা করে দুধের প্যাকেটও দিয়েছেন। শহরের লেখক-শিল্পীদের একাধিক সংগঠন একাধিক ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনই একটি সংস্থা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে চা-বাগানেও পৌঁছে গিয়েছে। ওই সংস্থার মানস চক্রবর্তী বলেন, “এখন খুব বিপদে আছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের পাশে থাকতে চাই।”