Idol Makers

চোখের আলোয় চোখের ছায়ায়

বাবা পাট চাষ করতেন। পুজোর অনেক আগেই পাট কাটা হত। তার পর ডুবিয়ে রাখা হত মাঠে, বৃষ্টির জলে। বড়দের মুহুর্মুহু বকুনির মধ্যেই সেই জলে নেমে হুটোপাটি চলত আমাদের।

Advertisement

রাধিকা রায়

উত্তরবঙ্গ শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২১ ১০:০৯
Share:

ওরা আমাকে দুর্গার চোখ আঁকতে দেয় না। দেখার চোখ কি তবে নেই আমার?

Advertisement

সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি, চাষের জমিতে কী ভাবে বীজ দেওয়া হচ্ছে, মাঠ ভরে উঠছে ফসলে। সে সব সবুজ ধানের দিন। আশ্বিনের হাওয়া হু হু করে ঘুরে বেড়াত খেতের মধ্যে। পাশের সবুজ মাঠেই হয়তো ছাল ছাড়ানো পাটের গোছা দাঁড় করানো আছে। মাঠের শেষে নালা। তাতে তখনও বর্ষার জল। ধারে ফুটেছে কাশ ফুল। আসছেন হিমালয় কন্যা পার্বতী, ঘর আলো করে।

তাঁর আসার পথ যেন এই ভাবে গড়ে উঠছে পরতে পরতে। আলোয়, হাওয়ায়। জমিতে, আসমানে।

Advertisement

বাবা পাট চাষ করতেন। পুজোর অনেক আগেই পাট কাটা হত। তার পর ডুবিয়ে রাখা হত মাঠে, বৃষ্টির জলে। বড়দের মুহুর্মুহু বকুনির মধ্যেই সেই জলে নেমে হুটোপাটি চলত আমাদের। বাবার হাতে তখনও ফসল বেচার টাকা আসেনি। সে আসতে আসতে পুজো ছুঁয়ে ফেলত আমাদের। নতুন জামা পেতে পেতে হয়তো সপ্তমী।

এই ভাবে ধীরে ধীরে, বছরের প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তকে নিয়ে এক পা এক পা করে গড়ে উঠত আমার ছোটবেলার পুজো। সে সব তো দুর্গার মতোই অঙ্গে ধরে বড় হয়েছি। তার পরে এক দিন পা বাড়িয়েছি শ্বশুরঘরে। চাষির মেয়ে থেকে হয়েছি কুমোর বাড়ির বউ। কাস্তে পড়ে রয়েছে পিছনে। হাতে এখন কাদা-মাটি। আর রং-তুলি।

বিয়ে হয়ে এলাম নতুন বউ। বাড়ির কত কাজ। তার মধ্যেই কিন্তু এসে বসতাম বরের পাশে। প্রথমে কঞ্চি বেঁধে কাঠামো হল। তার পরে বাঁধা হল খড়। তাকেই তো বলে পোয়াল বাঁধা। সে কাজের শেষে মাটি চড়বে। শুকিয়ে ফেটে ফুটে যায় মাটি। তখন তাতে পড়ে দ্বিতীয় পরত। শেষে হয় রং।

তরুণ জোয়ান বর মাটি দিত কাঠামোয়। তার হাতে, গায়ে লেগে থাকত কাদা। কঞ্চির বেড়ার ঘরে আলপনার মতো এসে পড়ত বর্ষাকালে মেঘ ভাঙা আলো। আমার চোখে ধাঁধা লেগে যেত। তার পরে কখন জানি না, হাতও লাগাতাম কাজে।

ছোটবেলায় সিনেমা দেখেছিলাম, মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। দুই ভাইবোন দেখতে গিয়েছে মাঠ পেরিয়ে। কয়লার ইঞ্জিন ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে গেল। ওই যে দিদি, দুর্গা, তার পরে ভাইয়ের হাত ধরে মাঠ পেরনো গরুকে হাঁক দিয়ে ঘরের পথে পা দিল। হারিয়ে না যায়!

মাঝে মাঝে মনে হয়, এ ভাবে কি সত্যি হারিয়ে যাওয়া যায়! ছোটবেলায় হঠাৎ হঠাৎ চেপে বসত হারানোর ভয়। আমিও সেই দুর্গার মতো পাশে ঘুমন্ত ভাইটার হাত চেপে ধরতাম। অথচ উলু দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে এক দিন আমাকেই হারিয়ে দিল অন্যের ঘরে।

বরের ঘরে এসে অবশ্য খুঁজে পেলাম নতুনকে। ওই যে কাঠ, খড়, মাটি, রংয়ে গড়ে উঠছে প্রতিমা, এই দেখার যেন শেষ নেই। ক্লান্তি নেই এই দেখার।

তবু কি আমার চোখ ফুটল না?

আমারও সংসার বড় হল। বুড়ো হল। আজ ওরা বাপ-ছেলে মিলে প্রতিমা গড়ে। আমিও হাত দিই ওদের সঙ্গে। মূর্তি শেষ হতে হতে বেজে ওঠে গান— ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। বাবার বাড়িতে একটা রেডিয়ো ছিল। ছোট থেকে তাতেই বাজে মহিষাসুরমর্দিনী, মহালয়ার দিন। সে রেডিয়ো দিনের ক্ষয়ে পুরনো হয়। আওয়াজ বাড়ে, কমে। তার পরে শ্বশুরঘরে চলে আসি। পেরিয়ে আসি এত দিনের পথ। এখন তো হাতে হাতে মোবাইল। তাতেই রেডিয়ো ধরে আমার ছেলে। আমাদের ছোট ঘরে সেই রেডিয়োই বাজে।

আমার কিন্তু ভাল লাগে পাড়া জুড়ে বাজতে থাকা রেডিয়োর পর রেডিয়োর শব্দ শুনতে। দোর খুলে বার হয়ে আসি। বাসি অন্ধকার মুছে যায় হাল্কা আলোয়। আমাদের কারখানার দরজা বন্ধ। গত বছর থেকে জানি, সেখানে এখনও রয়েছে কয়েকটি মূর্তি। নেওয়ার কেউ নেই। হয়তো থেকেই যাবে। হাতগুলি তার মুঠো করা, কিন্তু অস্ত্র নেই একটিতেও। হয়তো জড়ো করা আছে কোনও কুলুঙ্গিতে। যারা কিনবে, তারাই অস্ত্র দেবে দুর্গাকে।

ওই হাতের মুদ্রা গড়তে বড় আঁট লাগে। এর মধ্যে বৃষ্টি হয়ে যায় মাঝে মাঝে। ব্লোয়ার দিয়ে মাটি শুকোই। একটু বেশি শুকিয়ে গেলে আঙুলে ফাট দেখা যায়। সে সব জায়গা মাটি বুলিয়ে ঠিক করতে হয়। বড় মমতা লাগে মাটি বোলানোর সময়ে।

অথচ কোথায় ছিল এই মূর্তি? ক’দিন আগেও তো শুধুই কঞ্চি আর খড়। তাতে যখন ছেলে দাঁড়িয়ে মাটি দিতে শুরু করে, আমার মনে হয়, কোথায় ছিল ছেলেটা? কিছু বছর আগে তো শুধুই মনের মধ্যে সেই জাফরি কাটা আলো। যখন সে জন্মাল, কাঁথাকানিতে শুয়ে হাত-পা ছুড়ত। মনে হত, এই আমার পৃথিবী।

অথচ গড়ে উঠল যখন, একেবারে আলাদা মানুষ তো!

বাপ-ছেলেতে মিলে রোজ সকালে চলে যায়। আমি আসি ঘরের কাজ একটু গুছিয়ে। সকালে উঠোন ঝাঁট দিই। তার পর গোবর ছড়াই। সকাল সকাল স্নান সেরে নেওয়া অভ্যাস আমার। তার পরে এক কাপ চা লাগবেই। চা শেষ করে রান্না বসাই। মেয়েটা কম্পিউটার ক্লাসে যায়। বাপ-দাদার সঙ্গে তাকেও গুছিয়ে দিতে হবে সব কিছু। সবাই বার হয়ে গেলে আমি সংসার গড়ে, গুছিয়ে ধীরেসুস্থে কারখানার দিকে যাই।

বিয়ের আগে দেখতাম পাট কাটা। বিয়ের পরে প্রতিমা গড়া। এই কাজটায় কিন্তু আমি প্রথম থেকেই হাত লাগিয়েছিলাম। একেবারে আনাড়ি। কিন্তু নতুন বর হাতে ধরে শিখিয়েছিল। তার পর আস্তে আস্তে সবই জানলাম। ঠিক জন্মরহস্যের মতো। বর বলেছিল, আমার হাত পড়ার পরে ঠাকুরের চাহিদা বেড়েছে। আমাকে লক্ষ্মী বলে শ্বশুরবাড়ির সবাই। দুর্গা নয় কিন্তু।

এখন তো আমাদের সকলের হাতে হাতে গড়ে ওঠে প্রতিমা। আর সব পুজো এক দিকে, দুর্গাপুজো আর এক দিকে। আর সব প্রতিমা এক রকম, দুর্গা প্রতিমা আর এক রকম। কত কাজ লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। শুধু মায়ের মূর্তি গড়লে হবে না। সঙ্গে ছোট মূর্তি লক্ষ্মী, সবস্বতী, কার্তিক, গণেশ। আছে বাহন, মহিষাসুর। এদের সকলের দেহ আছে, আছে চোখ।

আমি রং করতে করতে আঁচলে হাত মুছি বেখেয়ালে। রং লাগা কাপড় পরতে কী যে ভাল লাগে! সে রং অবশ্য থাকে না। আশ্বিনের রং ধুতে ধুতে উঠে যায় পৌষের মধ্যেই। তবু শাড়িতে লেগে থাকা মাটির হাল্কা গন্ধ জানিয়ে দেয়, গড়ার দায়িত্ব আমাদের। মেয়েদের, মায়েদের।

তবু চোখ আঁকা হয় না আমার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement