শিলিগুড়ির মাটিগাড়ায় স্কুল বাসের বিরুদ্ধে পরিবহণ দফতরের অভিযান। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
স্কুলবাস নিয়ে ঘোরতর লড়াই। এক দিকে অভিভাবকেরা যখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মানা হয় না বলে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন, তখন উল্টো দিকে এক শ্রেণির বাস মালিক ভাড়া বাড়ানো নিয়ে চাপ বাড়ানোর পাল্টা কৌশল নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। অভিভাবকদের আরও দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের একটি অংশ এই মালিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন।
সোমবারও যেমন এই নিয়ে কম টানাপড়েন গেল না! এ দিন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিলিগুড়ির পরিবহণ দফতরের কয়েক জন অফিসার স্কুলবাসের নথিপত্র পরীক্ষা করতে নামেন। অভিভাবকদের কয়েক জনের অভিযোগ, বাসে তল্লাশির সময়ে অনেক নথিপত্র পাননি অফিসারেরা। কিন্তু সেই বাসগুলিকে জরিমানা না করে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন এই দাবি মানতে চায়নি। পুলিশ সূত্রের খবর, হঠাৎ বাস দাঁড় করিয়ে পরীক্ষা করায় অনেক বাসেই গলদ ধরা পড়েছে। বেশ কিছু বাসকে জরিমানাও করা হয়েছে। এক চালকের ঠিক লাইসেন্স ছিল না বলে সেই ‘সিজ’ অবধি করা হয়েছে। দার্জিলিঙের আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক রাজেন সুনদাস বলেছেন, ‘‘নথিপত্র ঠিক না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে জরিমানা করার কথা। প্রয়োজনে বাস আটকে তা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। আমরা লাগাতার অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছি।’’
উল্টো দিকে বাস মালিকদের বক্তব্য, তাঁরা গরমের ছুটির পরেই যাবতীয় ত্রুটি শুধরে নেবেন। কিন্তু, সে জন্য বাসের ভাড়া বাড়াতে হবে বলে মালিকপক্ষের কয়েক জন দাবি করেছেন। তাঁদের এই দাবি আবার অভিভাবকেরা মানতে নারাজ। উত্তরবঙ্গের অভিভাবক মঞ্চের তরফে সন্দীপন ভট্টাচার্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে যে হারে পড়ুয়াদের থেকে ভাড়া আদায় হচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। সন্দীপনবাবু বলেন, ‘‘কোন বাস মালিক কত টাকা লাভ করছেন, কার একটি বাস থেকে ১০টি বাস হয়েছে— সে সব তথ্য আমাদের কাছেও আছে। আয়কর দফতরের কাছেও রয়েছে। পুরসভার কাছেও অনেক তথ্য আছে। বাস মালিকদের কয়েক জন দিনের পর দিন লোকসানের কাঁদুনি গাইলেও আসল ঘটনা কিন্তু তা নয়।’’
আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের পক্ষ থেকে ল্যারি বসুও মনে করেন, বাস মালিকদের একাংশ ক্রমাগত ভাড়া বাড়িয়ে চললেও সরকারি তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেই তাঁরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। ল্যারিবাবু বলেন, ‘‘এমনিতেই ৩৬৫ দিনের মধ্যে শনি-রবিবার, শীত-গ্রীষ্ম-পুজোর ছুটি মিলিয়ে প্রায় ১৮৮ দিন স্কুল বন্ধ থাকে। অর্থাৎ ৬ মাস স্কুল হয় না। কিন্তু, বাস মালিকরা ১২ মাসের বাড়া নেন। তাতে লাভের অঙ্ক বাড়ে। তা হলে ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন ওঠে কেন! সরকারকে দেখতে হবে।’’
শিলিগুড়ির অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও বাস মালিকদের কাছে গাড়ি পিছু খরচের হিসেব প্রকাশ্যে আনার দাবি তোলা হয়েছে। কয়েক জন অভিভাবক বলেন, ‘‘ফি বছর টাকা জমা দিতে গেলেই এক বাস মালিক কান্নাকাটি করে বলতে থাকেন, স্কুলবাসের লাইন নাকি ছেড়ে দেবেন। অথচ ফি বছর ওই মালিককে অন্তত দু’টি করে বাস কিনতে দেখা যায়!’’ এখানে কয়েক জন অভিভাবকের প্রশ্ন, ‘‘বাস মালিকদের যদি লাভই না হয়, তা হলে কেন তাঁরা ব্যবসা ছেড়ে দেন না? দিনের পর দিন লোকসানে ব্যবসা করছেন কেন?’’
এই প্রসঙ্গে বাস মালিক সংগঠনের কয়েক জন সদস্য একান্তে জানান, হাতে গোনা দু’একটা গাড়ি নিয়ে যাঁরা ছোটখাট স্কুলে চালান, তাঁদের লাভের অঙ্ক বড়ই কম। কিন্তু, বড় স্কুলে লাভের অঙ্ক ফি বছর লাফিয়ে বাড়তে থাকে বলে তাঁরাও মেনে নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বড় স্কুলের অনেক মালিকপক্ষ ভাড়া না বাড়িয়ে নতুন বাস চালালেও ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা নেই বলেও তাঁদের কয়েক জন একান্তে জানিয়েছেন। এর উল্টো মতও অবশ্য রয়েছে। যেমন, মাটিগাড়ার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চলে লোকনাথ পরিবহণের বাস। তার কর্ণধার অমিতাভ সাহা রায় দাবি করেন, তাঁরা সমস্ত সুবিধা রাখতেই পারেন। কিন্তু সে সব করতে গেলে ভাড়া বাড়াতে হবে। তাঁর দাবি, ‘‘অনেকে অনুরোধ করে ভাড়া কমানোর জন্য চাপ দেন। ফলে যতটা কম ভাড়ায় আমাদের চালাতে হয়। ফলে সমস্ত ব্যবস্থা রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এর আগে পানীয় জল রাখা হয়েছিল। তা খাওয়ানোতে আমাকে অভিভাবকদের একাংশ আপত্তি করায় জল রাখিনি।’’ তবে বাকি ত্রুটি তিনি দ্রুত শুধরে নেবেন বলে আশ্বাস দেন। বাস মালিক বাবু ঘোষের গাড়ি চলে শিলিগুড়ির ফুলবাড়ির একটি স্কুলে। তাঁরও দাবি, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যে ভাড়াতে তাঁরা নিয়ে যান, তাতে সব রকম ব্যবস্থা রাখা সম্ভব নয়। তিনি বলেন ‘‘যদি অভিভাবকেরা বর্ধিত ভাড়া দিতে রাজি থাকেন, তা হলে আমরা সমস্ত আইন মেনে ব্যবস্থা রাখব।’’
বাস মালিকদের একাংশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছেন শিলিগুড়ি আদালতের আইনজীবী তথা নাগরিক সমিতির কর্ণধার রতন বণিক। তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননার মামলা দায়ের হতে পারে। ইতিমধ্যেই অভিভাবকদের কয়েক জন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে পারমর্শ শুরু করেছেন। আশা করব, পরিবহণ দফতর ভাড়ার হার ঠিক আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখবে। আমরাও শিলিগুড়ির মানুষের সঙ্গে আছি।’’
শিলিগুড়ির এআরটিও নবীন অধিকারী জানান, স্কুল বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। স্কুল বাসে ভাড়ার হারের বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন আরটিও।