বারবার নষ্ট আরশিতে ভেসে ওঠে তার মুখ।
চোখ বন্ধ করলেও সেই সাদা-কালো আলোয়-ছায়ায় ঘেরা দুই কাজল নয়ন জেগে থাকে।
ঘসা কাচের উপরে ঠিকরে পড়ে জানলার আলো। মাঝে দাগ কেটে যায় শিকের ছায়া। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে সামান্য পেরেকে নিজের অস্তিত্ব আটকে রাখা সেই আরশি দুলে ওঠে একটু হাওয়াতেই। লম্বা চুলের দু’এক ফালি অবাধ্য হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মুখের উপরে। সে সব সরিয়ে হেসে ওঠে চোখ দু’টি। নড়ে ওঠে অধর। সে সব ছায়া পড়ে আরশিতে।
বাইরে থেকে ডাক আসে: ওলো, ওঠ এ বারে। সাজতে চল। বেলা যে বয়ে গেল!
তার মুখে হঠাৎই ষাট ওয়াটের ডুমের আলো। সে-পাড়ার নামহীনার মতো হয়ে যায় ক্রমশ। সাদা-কালো ছবিতে রং লাগে। মেক-আপ। বাইরের আলো নিভে যায়। আলগোছে চুল ক’টাকে সরিয়ে সে মুখ ঝামটা দেয় অদৃশ্য মানুষটিকে, হুঁহ্ মরণ!
‘জংলা পাখি কখনও পোষ না মানে!’
মিহি সুরের এই আভা হয়তো পৌঁছয় মাটি-দরমার বেড়া পাড় হয়ে, কাপড়ের দরজা ভেদ করে কাঁথায় শুয়ে থাকা রোগক্লিষ্ট কিশোরীর কাছেও। আপনা থেকে মাথা দুলে ওঠে তার। বন্ধ চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসে জল। ভাই পাশে ঘন হয়ে বসে রোগা হাত দু’টি জড়িয়ে ধরলে মেয়েটি ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে, ‘‘আমাকে একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?’’
যে মাঠের উপর দিয়ে গরুর খোঁজে গিয়েছিল ওরা, তার ঘাটে-আঘাটায় কাশফুল ফুটে সাদা হয়ে আছে। চুপ করে দাঁড়ালে সেখানে শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়। বাতাসের? নাকি দূরদূরান্তে চলে যাওয়া দু’টি লাইন আর তার মাথার উপরে টানা বাঁধা তারগুলির?
ওই লাইনের উপর দিয়ে যাবে সেই গাড়ি, যাতে প্রেমবতীয়ারা হয়তো বসে আছে। কপালের মেটে সিঁদুর মুছে, সাদা থান পরে। শ্যামা, সুন্দরী সদ্য যৌবনা শ্যামার মুখের উপর থেকে ওড়না উড়ে গেলে দেখা যায়, লেগে আছে তখনও সাধ-আহ্লাদের ইচ্ছেটুকু, যা আসলে প্রয়াগের জলে আগের দিনই বিসর্জন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বামীর চিতাভস্মের সঙ্গে। বা তারও আগে, যখন তিন বিয়ের পরে প্রৌঢ় তার গলায় মালা দিয়েছিল।
সেই কিশোরী মেয়েটি কিন্তু এদের কথা জানে না। তার সাধ্যই বা কতটুকু! ভাইয়ের সঙ্গে গরু খোঁজার নামে হঠাৎই রেললাইন আবিষ্কার করে সে শুধু ট্রেন দেখতে চেয়েছিল। শুয়ে শুয়ে সে তখন ঝিকঝিক করে কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাওয়া বগিগুলির কথাই ভাবে।
সেই ট্রেন যদি কোনও ভাদ্রের সন্ধ্যায় আচমকা আপনাকে গোত্রহীন কোনও স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যায়, যেখান থেকে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে গাঁয়ের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র হাড় জিরজিরে গরুতে টানা গাড়ি, তখন আপনিও দিনের শেষে পৌঁছবেন এমন এক ঘরে, আবিষ্কার করবেন এমন এক খণ্ডহর, যেখানে অপেক্ষা নামে এক বৃদ্ধা বসে আছেন। চোখের আলো নিভে গিয়েছে। তবু তিনি বসে আছেন, কবে তাঁর যামিনীর জন্য ফিরে আসবে সুপাত্রটি।
জ্যোৎস্নার আলোর মতো ছড়িয়ে পড়া এমন ভালবাসায় জগৎ ভিজে যায়। যামিনী, সে তো চাঁদের আলোয় ভেজার জন্যই। সেই রং, সাদা-কালোর নামে অপার্থিব সেই আলো কখন যে গড়িয়ে ঢুকে পড়েছে চটের দরজা ঠেলে ভাঙা ঘরে, কে দেখেছে! সেখানে শুয়ে আছে রোগক্লান্ত কিশোরী। পাশে হাওয়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন মা। অন্য বিছানায় দেবশিশুর মতো মুখে ঘুমে স্বপ্ন দেখছে ভাই।
কিশোরীটি তখনও জেগে। সে অনুভব করে ভালবাসা। অন্ধকারেও দেখতে পায়, দূরতর দারুচিনি দ্বীপ। চোখে লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন।
তবু এ সব অবান্তর, জানে দুর্গা। পাশ ফিরে শোয় সে। নষ্ট আরশিতে ছায়া পড়ে তার।
চোখ বোজে দুর্গা। শেষ বার।