শিলিগুড়ির ঋষি অরবিন্দ রোডে মোটরবাইকের সারি। —নিজস্ব চিত্র।
কিছুদিন আগেকার ঘটনা।
টলিউডের এক অভিনেতা তথা রাজনৈতিক নেতা শিলিগুড়িতে এসেছিলেন। তাঁর আগে পিছে ছিল অনুগামীদের পাঁচটি গাড়ি। দুপুরবেলায় শহরের হিলকার্ট রোডের এক রেস্তোরাঁয় তাঁরা গিয়েছিলেন। পর পর ছ’টি গাড়ি হিলকার্ট রোডের উপরে রেখে অনুগামীদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় উঠে গিয়েছিলেন নেতা তথা অভিনেতা। যথেচ্ছ গাড়ি দাঁড় করানোয় ততক্ষণে হিলকার্ট রোডে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে শুরু করেছে।
এর পরে দেখা গিয়েছিল, ট্রাফিক পুলিশের কর্মীরা গিয়ে নেতা তথা অভিনেতার গাড়ি দেখে ওয়াকি-টকিতে কোথাও কিছু জানালেন। ও প্রান্ত থেকে কী নির্দেশ এসেছিল জানা যায়নি। তবে মুহূর্তের মধ্যে দেখা গিয়েছিল, ট্রাফিক পুলিশের সকলে যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে সরে পড়লেন। সে দিন নেতা-অভিনেতা রেস্তোরাঁয় ছিলেন প্রায় দু’ঘণ্টা। সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টা যানজটে জেরবার ছিল শহর শিলিগুড়ি। হিলকার্ট রোডের ব্যবসায়ীদের কয়েকজন সে দিনের সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘‘আমাদের নেতা-কর্তারা যদি এমন করেন তা হলে শহরের পার্কিং ব্যবস্থার বেহাল দশা ঘুচবে কী ভাবে!’’
অথচ ঘটনাচক্রে ওই সিনেমা তারকা কাম নেতা আরেক সফরে সিকিমের গ্যাংটকে গিয়ে যথেচ্ছ পার্কিং করতে পারেননি। বিস্তর চেঁচামেচি করে সিকিম পুলিশের ট্রাফিক-কর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ওপরওয়ালাদের জানিয়ে বদলির হুমকি দিয়েছেন। চেঁচিয়ে রাস্তায় লোকজন জড়ো করেছেন। কিন্তু, সিকিম পুলিশের অফিসার-কর্মীরা একবাক্যে সকলে জানিয়ে দিয়েছেন, আইনের চোখে সকলেই সমান। শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে ওই নেতা তথা অভিনেতাকে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। তবে সিকিম পুলিশ কিন্তু বিধি অমান্য করায় গাড়ির চালকের জরিমানা করতে ছাড়েনি।
এমন অনেক অভিযোগ, ঘটনার কথা জানে শিলিগুড়ির বণিক মহল। তাই সিআইআই-এর উত্তরবঙ্গ শাখা কিংবা আরেকটি সংগঠন ফোসিনের একাধিক প্রতিনিধি একান্তে আক্ষেপ করে প্রশ্ন তোলেন, পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে সিকিম যা পারে তা শিলিগুড়ি পারে না কেন?
প্রথম ও প্রধান কারণ হল, সেখানকার বাসিন্দারা সকলে শহরে সুপরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে প্রতি পদক্ষেপে ট্রাফিক বিধি মেনে চলার ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন। সিকিমের তাবড় নেতারাও কখনও ট্রাফিক আইন ভাঙেন না। খোদ মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং পর্যন্ত বিধি ভেঙে গাড়ি পার্কিং করান না। শুধু তাই নয়, শহরে যাতে যথেচ্ছ যানজট না হয়, সে জন্য গাড়ি ছেড়ে মাইলখানেক পথ হাঁটতেও কারও আপত্তি দেখা যায় না সিকিমের রাজধানীতে। এমনকী, শিলিগুড়িতে যানবাহন ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না যাঁরা, তাঁদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে গ্যাংটকে হাঁটতে হয়।
সিকিম পুলিশ সূত্রের খবর, বিষয়টি রাতারাতি হয়নি। বেশ কয়েক দফায় সব দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছে রাজ্য সরকার। সব দলের নেতারা একমত হয়েছেন, যে রাজধানীর রাস্তা যানজট মুক্ত রাখতে সকলকে কিছু বিধি নিষেধ মেনে চলতেই হবে। সেই মতো রূপরেখা তৈরি হয়েছে। শহরের বাসিন্দা, ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা সেই রূপরেখা মেনে চলবেন বলেও অঙ্গীকার করেছেন। এর পরে কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ ও হাঁটার জন্য রেলিং ঘেরা ফুটপাত তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে সিকিমের রাজধানীতে যানজট আগের চেয়ে অনেক কমেছে। শহরও অনেক ছিমছাম হয়েছে।
শিলিগুড়ি পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের অনেকেই একান্তে মানছেন, সিকিমের রাজনৈতিক দলের নেতারা একমত হয়ে শহরের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলেও সে কাজটা সমতল শিলিগুড়িতে সহজে সম্ভব নয়। পুলিশ-প্রশাসনের কয়েকজন অফিসার জানান, যদি তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি সহ সব বড়-ছোট দল একসুরে পার্কিং-বিধি মানতে রাজি হয় তা হলে এই পরিকাঠামো নিয়েই রাতারাতি যানজট অন্তত ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। কারণ, আমজনতা, ছোট-বড় ব্যবসায়ীরাও দৈনন্দিন ‘পার্কিং সমস্যা’ থেকে রেহাই চান।
কিন্তু, ভোটের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শিলিগুড়ির স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন কজন রাজনৈতিক নেতা? তা ছাড়া নেতাদের একাংশ শহরের উন্নয়নের স্বার্থে যে সব পদক্ষেপের চিন্তাভাবনা করেন, তার ধারাবাহিকতা অনেক ক্ষেত্রেই রাখেন না বলে অভিযোগ। বিশেষত, নানা সময়ে শহরের পার্কিং-সমস্যা মেটাতে নানা প্রকল্প, পদক্ষেপের কথা বলেও তা নিয়ে এগোতে চাননি অনেক নেতাই। অনেকেরই অভিযোগ, ডান-বাম উভয় দলের অনেক নেতাই পার্কিং সমস্যা মেটাতে শহরে এক পা এগিয়ে নানা কারণে ১০ পা পিছিয়ে গিয়েছেন।
যেমন, ২০০৯ সালে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট শিলিগুড়ি পুরবোর্ডে ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে শহরে ৩ দফায় বেআইনি পার্কিং হটানোর অভিযান শুরু হয়। প্রতিবারই ২-৩ দিনের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এক নেতা অভিযানে নামলে আরেক নেতা পরদিন গিয়ে বিরোধিতা করেছেন বলে অভিযোগ। খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব কোর্ট মোড় থেকে হেঁটে বেআইনি পার্কিং সরাতে সরাতে হিলকার্ট রোড ধরে এগিয়েছিলেন একদিন। ব্যস! সাত দিন পর থেকে ফের বেআইনি পার্কিং রমরমিয়ে চলছে। না হলে বিধান মার্কেট লাগোয়া ঋষি অরবিন্দ রোডে দিনের পর দিন যথেচ্ছ বাইক পার্কিং চলতে পারে! সেবক রোড, হিলকার্ট রোড, কিংবা কোর্ট মোড় লাগোয়া এলাকায়, হাসপাতাল মোড়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী গায়ের জোরে রাস্তার ধারে ব্যারিকেড দিয়ে বেআইনি পার্কিং চালাতে পারতেন?
তৃণমূল-কংগ্রেস জমানায় কাজটা শুরু হয়েও থমকে গিয়েছে। তার আগে বামেদের আমলে কী হয়েছে? এটাও ঘটনা যে শিলিগুড়ির পার্কিং সমস্যা মেটাতে একটু এগিয়ে অনেকটা পিছু হটার ক্ষেত্রে বামেরাও কম যান না। (চলবে)