বাধা: বেআইনি ভাবে মজুত করে রাখা হয়েছে বালি-পাথর। সোনাখালিতে। নিজস্ব চিত্র
ঠিক যেন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে!
হাতি চলাচলের রাস্তা আটকে বালি, পাথর, পাথরের গুঁড়ো স্তূপ করে জমিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ করছিলেন স্থানীয়রা। বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরের সময়ে তাঁর কাছেও সেই অভিযোগ পৌঁছেছিল। তার পরেই মঙ্গলবার রাতে পুলিশ এবং ভূমি দফতর যৌথ অভিযান চালিয়ে ধূপগুড়ির সোনাখালি জঙ্গল এলাকা থেকে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ধৃত ব্যক্তি সরকারি জমি দখল করে অবৈধ ভাবে বালি-পাথর মজুতকারীদের অন্যতম পাণ্ডা বলে দাবি। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, এই স্তূপ করা বালি-পাথর তোলা হয়েছে অবৈধ খাদান থেকে তোলা। ভূমি দফতরের দাবি, পুরোটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় ক্রাশার অর্থাৎ পাথর গুড়ো করার কারখানা তৈরির মতলব ছিল। এই ক্রাশার সম্পূর্ণ বেআইনি বলে জানিয়েছে প্রশাসনেরই একটি অংশ। অন্য দিকে বন দফতরের দাবি, পাথর আর বালি স্তূপ এত উঁচু যে হাতিদের পক্ষে তা টপকানো কঠিন। ফলে তারা এক জঙ্গলে থেকে বার হয়ে আর এক জঙ্গলে যাওয়ার পরিচিত রাস্তায় বাধা পেয়ে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়ছিল আশেপাশের গ্রামে। পরিবেশপ্রেমীরা বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন।
ধৃত সোহেল রহমানকে এ দিন বিকেলে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে তুললে শর্তসাপেক্ষে জামিন হয়। তাঁর আইনজীবী অভিজিৎ সরকার বলেন, ‘‘আইন মেনেই কাজ চলছিল। জমি আইন কোথাও ভঙ্গ হলে জরিমানা করা যেতে পারত। প্রশাসন অতিসক্রিয় হয়েছে। আদালতে সব কাগজ জমা দিয়েছি।’’ ধূপগুড়ি শহর থেকে বীরপাড়া যাওয়ার পথে বাঁ দিকে সোনাখালির জঙ্গল। এশিয়ান হাইওয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে গিয়েছে। এই জঙ্গলে বছরে সব সময়ে হাতির দল থাকে। আশেপাশের ডায়ানা, মরাঘাট ও তোতাপাড়া জঙ্গলের সঙ্গে যোগ রয়েছে সোনাখালির। হাতির দল কখনও সোনাখালি জঙ্গল থেকে বার হয়ে চামড়াগুদাম এলাকার মাঝখান দিয়ে ডায়ানার জঙ্গলে, কখনও রেতির জঙ্গলে, কখনও দলগাঁও পর্যন্ত চলে যায়। আবার দলগাঁও জঙ্গল থেকে উল্টো পথে নিজেদের মর্জিমাফিক হাতির দল ফিরেও আসে। বুনো হাতির দল একেক সময়ে একেক জঙ্গলে থাকতেই পছন্দ করে বলে পরিবেশপ্রেমীদের দাবি। সারা বছর ধরেই এ জঙ্গল থেকে ও জঙ্গলে যাতায়াত করে তারা।
উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল লাগোয়া এলাকায় হাতির এই পথ সুরক্ষিত রাখতে করিডর হিসেবে চিহ্নিত করা রয়েছে। বন্যপ্রাণী আইনে এই করিডরে বাধা তৈরি করা বেআইনি এবং অপরাধযোগ্য। পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ, ধূপগুড়ির সোনাখালি জঙ্গল এবং চামড়াগুদামের মাঝে ওই করিডরের মধ্যেই বাধা তৈরি হয়েছিল। কিছু দিন আগে ধূপগুড়ির একটি চা বাগানে শাবক হাতি আটকে পড়েছিল। পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, করিডরে বিশাল পাথর-বালির স্তূপ থাকায় শাবক হাতিটি পথ ভুল করে অন্য রাস্তায় ঢুকে যায়।
সোনাখালি জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় শুধু বালি-পাথরের স্তূপই নয়, পে লোডার দিয়ে গর্তও খোঁড়া চলছিল বলে অভিযোগ। সেখানে নির্মাণ করে ক্রাশার মেশিন বসানোর পরিকল্পনা ছিল বলে দাবি। জলপাইগুড়ির ডিএফও মৃদুল কুমার বলেন, “বন্যপ্রাণীদের করিডরে এ ভাবে বাধা তৈরি করা যায় না। তা হলে হাতি-সহ বন্যপ্রাণীরা পথ পরিবর্তন করে গ্রামে ঢুকে পড়তে পারে। ভূমি রাজস্ব দফতর ও পুলিশকে লিখিত অভিযোগ করেছি।’’
ধৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ বালি-পাথর মজুত করা, বন্যপ্রাণী করিডরে বাধা তৈরি করা-সহ ছ’টি ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ধূপগুড়ি থানার আইসি সুবীর কর্মকার বলেন, “বন দফতর এবং ভূমি রাজস্ব দফতর অভিযোগ করেছিল। তার ভিত্তিতেই মামলা শুরু হয়। আপাতত একজন গ্রেফতার হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’
পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “হাতিরা কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের যাতায়াত করা করিডর বদল করে না। তাই বাধা পেলে তারা আশেপাশের গ্রামে ঢুকে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদেরই সাবধান এবং সচেতন হতে হবে।’’