বাঁ দিকে সম্প্রতি পানের দোকানে ব্যস্ত সুজিত পাল। ডান দিকে আগে মূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত শিল্পী। —নিজস্ব চিত্র।
প্রতি বছর রথের রশিতে টান পড়তেই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে কোচবিহারের পলাশবাড়ি রোডের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের। কোচবিহারের ওই ওয়ার্ডের ভাল নাম কুমোরটুলি। শহরবাসীর কাছে পরিচিত পালপট্টি নামে। করোনার জেরে গত বার থেকেই সেই ব্যস্ততায় ভাটা পড়েছে। তবু চলছিল টেনেটুনে। তবে এ বার সেই ব্যস্ততা একেবারেই উধাও। কাঠামো এবং মাটির উপরে রং-তুলি দিয়ে সৃষ্টিসুখ ছেড়ে পানের দোকানে মন দিয়েছেন মৃৎশিল্পীদের কেউ কেউ।
পালপট্টির বাসিন্দা সুজিত পাল। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। পরিবারে রয়েছেন মা, স্ত্রী এবং মেয়ে। ঠাকুরদা এবং বাবা মৃৎশিল্পী ছিলেন। বয়স বছর দশেক গ়ড়ানোর আগেই কাদার তাল থেকে মূর্তি তৈরি শিখে গিয়েছিল সুজিতও। দাদা বাদলের হাতে তার হাতেখড়ি হয়েছিল। মাধ্যমিক পাশ করতে না করতেই পুরোদস্তুর শিল্পী বনে যান তিনি। সরাসরি প্রতিমা গড়ার কাজে নেমে পড়েন। তার পর থেকে টানা সাড়ে তিন দশক ধরে চলছে এই কাজ। কিন্তু করোনা যেন যতি চিহ্ন টেনে দিয়েছে সৃষ্টি-শিল্পে। জাত ব্যবসায় বেগতিক দেখে সুজিত পানের দোকান খুলেছেন আয়ের বিকল্প চিন্তায়। অন্য সময় হলে শরতের এই সময়ে তুমুল ব্যস্ততায় দিন কাটত তাঁর। কিন্তু এ বার ভিন্ন ছবি।
প্রতিমা তৈরির বরাত নেই বললেই চলে। তাই পান সেজেই দিন কাটছে প্রতিমাশিল্পীর। আক্ষেপ হয় না? প্রশ্নটা শুনেও গায়ে মাখলেন না সুজিত। বরং দূরে দৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়ে বললেন পুরনো দিনের কথা। বাপ-ঠাকুরদা তো বটেই, বছর দুয়েক আগে কেটে যাওয়া শরতের এই সময়টা স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। স্মৃতির সুতোয় টান দিয়ে সুজিত বলছেন, ‘‘প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫টি প্রতিমা আমি তৈরি করি। আমার তৈরি প্রতিমা অসম-সহ অন্যান্য রাজ্যে গিয়েছে। আগে সারা বছর প্রতিমা তৈরি করতাম। পুজোর সময়েও আমাদের উপার্জন ভাল হত।’’ কিন্তু এখন? প্রশ্নটা যেন স্মৃতির সরণি থেকে বাস্তবতার মাটিতে নামিয়ে আনল সুজিতকে। বদলে গেল তাঁর চাউনিও। সংক্ষেপে বললেন, ‘‘বেঁচে থাকার ল়ড়াই তো চালাতে হবে।’’
প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত সুজিত পাল। নিজস্ব চিত্র
ফেলে আসা সময়ের সঙ্গে তুলনা টেনে সুজিত বলছেন, ‘‘আমরা গত ৮৫-৮৬ বছর ধরে বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে ঠাকুর তৈরি করে আসছি। চোখের সামনে ঢের অভাব দেখেছি। তবে এই পরিস্থিতি আগে কখনও দেখিনি। দুর্গাপুজোর বাকি আর মাত্র দু’মাস। অথচ এ বার মাত্র ছ’খানা প্রতিমা তৈরির বায়না পেয়েছি। অন্য রাজ্য থেকেও কেউ প্রতিমার বরাত দেননি। এ বারে দুর্গাপুজো সে ভাবে হবে কি না ঠিক নেই। তাই বারোয়ারিগুলি প্রতিমার বায়না দিতে চাইছে না।’’
সুজিতের মতো পরিস্থিতি পালপট্টির অনেকেরই। অন্য এক শিল্পী বিভাস পাল যেমন বললেন, ‘‘গত দু’বছর ধরে আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। গত বছর তা-ও কয়েকটি প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। এ বছর তো কেউ বরাতই দেয়নি।’’ একই কথা বলছেন পালপট্টির বাসিন্দা পুলক পালও। আশঙ্কা ভরা গলায় তিনি বললেন, ‘‘প্রতি বছর সাত থেকে আট লক্ষ টাকার প্রতিমা তৈরি করি। কিন্তু গত বছর সেই অঙ্ক কমে হয়েছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। এ বছর হয়তো অবস্থা আরও তলানিতে নেমে যাবে। প্রতিমার বায়না না পাওয়ায় অনেক শিল্পীই অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।’’
জীবন-সঙ্কট এক ঝটকায় কৃষক থেকে ফুলবেড়ের চটকলের শ্রমিক হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছিল দিয়েছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহেশ গল্পের অন্যতম চরিত্র গফুর মিয়াকে। কাশীপুর গ্রামের সেই ক্ষুদ্র কৃষকের সেই পেশাবদলের ছবি যেন তাড়া করছে কোচবিহারের পালপট্টিকেও।