প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে গেল প্রাণ

অনেকেই নামতে চাইছিলেন, আমি প্রাণপণে ঠেকাই

ভরদুপুরে এক মহিলার গলায় হঠাৎই আর্ত চিৎকার শুনে চমকে যাই। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা হবে। প্রথমটায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। হঠাৎই দেখি আশেপাশের সকলে আমার দোকানের পিছন দিকের একটি বাড়িতেই ছুটে যাচ্ছে।

Advertisement

বিষ্ণু প্রসাদ (ব্যবসায়ী, চম্পাসারি)

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৬ ০২:০২
Share:

এই কুয়োতে নেমেই ঘটে বিপত্তি। নিজস্ব চিত্র

ভরদুপুরে এক মহিলার গলায় হঠাৎই আর্ত চিৎকার শুনে চমকে যাই। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা হবে। প্রথমটায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। হঠাৎই দেখি আশেপাশের সকলে আমার দোকানের পিছন দিকের একটি বাড়িতেই ছুটে যাচ্ছে। ওই বাড়ির সকলে আমার পরিচিত। শুনতে পাই রাজেশ খাতি নামে একজন কুয়ো সাফ করতে নেমে আটকে পড়েছে। রাজেশ আমার অত্যন্ত পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। বিন্দু মাত্র দেরি না করে আমিও ছুটে যাই। বাড়ির ভিতরে কুয়োর চারপাশে তখন ভিড়। সকলে বলাবলি করছে কুয়োর ভিতরে নাকি তিন জন আটকে রয়েছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি বুক জলে রাজেশ ডুবে রয়েছে। ওঁর শরীর এলিয়ে পড়েছে। বাকি একজনও নিথর হয়ে রয়েছে। অন্যজন রাজেশের কোমরে দড়ি বাঁধার চেষ্টা করছে। এমন দৃশ্য দেখে কী করব, প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।

Advertisement

কিছু ক্ষণ পরে সম্বিত পেরে। চিৎকার করে বলি, ‘‘জলদি দড়ি বাঁধো।’’ আরও দু’টি দড়ি আনতে বলি সবাইকে। দড়ি বাঁধা হলে রাজেশকে টেনে উপরে তোলা হয়। নাকের নীচে হাত রেখে দেখি রাজেশের নিঃশ্বাস পড়ছে। বুঝতে পারি ও তখনও বেঁচে আছে। কোনও মতে টান দিয়ে দড়ি খুলে ফের কুয়োয় নামিয়ে দিই। কিন্ত যে ব্যক্তি রাজেশের কোমরে দড়ি বেঁধে দিল, সে দেখি কিছুতেই হাত দিয়ে দড়ি টানছে না। আমি উপর থেকে চিৎকার করে বলতে থাকি, ‘‘দড়িটা নিজের কোমরে বেঁধে নাও।’’ কিন্তু আমার বা অন্যদের চিৎকার যেন কুয়োর ভিতরে থাকা রাজেশকে উদ্ধার করতে নামা দু’জনের কানেই যাচ্ছিল না। এক জনের দু’টি হাত শরীরের সঙ্গে লম্বালম্বি করে রাখা। অন্য জন যেন দড়ির দিকে হাত বাড়িয়েও থমকে গিয়েছেন। বেশ কিছু ক্ষণ এমন ভাবে কাটার পরে আশঙ্কা করি, ওঁরা দু’জনেই বেঁচে নেই।

কুয়োর আশেপাশে জড়ো হওয়া ভিড়টা তখন একেবারে নিস্তব্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতবাক। চোখের সামনে দু’টি প্রাণ নিথর হয়ে যাবে, কেউ ভাবতে পারে! কিন্তু দুই সাহসী উদ্ধারকারীকে তো তুলে হবে। আরও কয়েকজন কুয়োয় নেমে পড়তে চাইছিলেন। আমি বাঁধা দিই। এক সময়ে গ্রামের বাড়িতে কুয়ো পরিষ্কার করার অভিজ্ঞতা আমারও রয়েছে। বুঝতেই পারছিলাম, জলে ডুবে দু’জনের মৃত্যু হয়নি। মিথেন গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। কুয়োর ভিতরে এমনিতেই মিথেন গ্যাস থাকে। তা ছাড়া এই বাড়ির কুয়োর পাশেই সেপটিক ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের গ্যাস বের হওয়ার জন্য ওপরে কোনও পাইপ নেই। কাজেই মাটির নীচ দিয়ে কুয়োতে সেই গ্যাস মিশেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বুঝতে পারি এখন যে কুয়োয় নামবে তাঁরই মৃত্যু। আমি একটু কেরোসিনে ভেজা ন্যাকরায় আগুন জ্বালিয়ে কুয়োয় নামিয়ে দিই। মুহূর্তে আগুন নিভে যায়। বুঝতে পারি কুয়োয় জমে আছে প্রচু গ্যাস। পরে দমকল কর্মীরা এসে ‘মাস্ক’ পরে কুয়োয় নেমে দু’টি দেহ উদ্ধার করে। তখন বাধা না দিলে আরও প্রাণহানি হতে পারত।

Advertisement

মৃতদের একজনকে চিনি। ডোলো সিংহ নামে সেই ব্যক্তি আমাদের পাড়াতেই থাকেন। অন্যজন শুনেছি রিকশা চালক। সম্প্রতি তাঁকে নাকি এলাকায় দেখা যাচ্ছিল। বালুরঘাটের বাসিন্দা শিলিগুড়িতে রিকশা চালাতে এসেছিলেন। তাঁর পরিচয় কেউ জানে না। তিনিও হয়ত এই এলাকার কাউকে চিনতেন না। কিন্তু শুধু কেউ বিপদে পড়েছে শুনে কুয়োয় ঝাপ দিতেও কোনও দ্বিধা করেননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement