উৎসবের আনন্দ ভুলে নদীতে হারানো জমির নথি খুঁজছেন রেণু

কাশবনের ভিতরে দু’দিন আগের বৃষ্টির জমা জল ডিঙিয়ে এগোতে থাকেন, উঁচু বাঁধ। পিচের রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে আলোর সাজ। ধুনোর গন্ধ। ঢাকের বোল। চুড়িদারের মজুরি।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ০৫:৪৩
Share:

উৎসব। নিজস্ব চিত্র

কাজের বাড়ি থেকে চুড়িদারের পিস পেয়েছেন রেণু। পাশের বাড়ির বউদির থেকে শুনেছেন, কাপড় কেটে চুড়িদার বানাতে দর্জিকে অনেক টাকা মজুরি দিতে হয়। রেণুর বাড়ি নদীর ধারে। নদীর ওপারে কাশফুল। দুপুরের দিকে হাওয়ায় কয়েকটা কাশফুল ওড়ে। তিন বাড়ি কাজ করে ফিরে নিজেদের রান্না করেন। কোলের ছেলেটাকে খাইয়ে, ঘুম পাড়াতে পাড়তে হাওয়ায় ওড়া কাশফুল চেনান। কাশের বাগান দেখায়। মানুষ উঁচু কাশের বাগানের মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা। আঁকাবাঁকা। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ে, রেণু হারিয়ে যান।

Advertisement

কাশবনের ভিতরে দু’দিন আগের বৃষ্টির জমা জল ডিঙিয়ে এগোতে থাকেন, উঁচু বাঁধ। পিচের রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে আলোর সাজ। ধুনোর গন্ধ। ঢাকের বোল। চুড়িদারের মজুরি। ঘোর ভাঙে রেণু কামতির। বাইরে কে যেন ডাকে। ভোটের কার্ড চাইতে এসেছেন এক দুরসম্পর্কের আত্মীয়। সঙ্গে পঞ্চাশটা টাকাও। ভোটের তালিকায় কম্পিউটারে কী যেন কাজ হচ্ছে, তাতে নাম না থাকলে দেশে থাকতে দেবে না, শুনেছেন রেণু। চুড়িদারের মজুরির জন্য জমিয়ে রাখা থেকে পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে যায় সেই আতঙ্ক। জলপাইগুড়ির বাঘাযতীন কলোনিতে জন্ম রেণুর। উদ্বাস্তু কলোনি। শ্বশুরবাড়ি কিংসাহেবের ঘাট লাগোয়া করলা নদীর চরে। স্বামী টোটো চালান। দুর সম্পর্কের আত্মীয় জানিয়েছেন, তাঁর বাবা-মায়ের জমির কাগজ লাগবে। ভোটের কার্ডে নাকি কিছুই হবে না। এই দেশের কোনও সরকারি খাতায় নাম থাকতে হবে। জমির কাগজ!

মাথাটা চক্কর দেয় রেণুর। ভাড়া নেওয়া এক কামরায় মা-বাবার সঙ্গে থেকেছেন। কে দেবে জমির কাগজ? চরের জমি প্রতি বছর একটু একটু করে নদীতে চলে যায়। নদীটা শ্বশুরবাড়ির দিকে এগিয়ে আসে প্রতিবছর, বাড়িটাও নদীর থেকে পিছিয়ে যায় একটু একটু করে। কোথাও আছে সেই জমির কাগজ? এত দিন ধরে, যে জমি নদীতে চলে গেল কোথায় তার কাগজ? বাবা-মা দিন মজুরি করত, সেই কাগজ কোনও অফিস দেবে? রেণু এখন তিনটে বাসাবাড়িতে কাজ করেন। সে কথা কী সরকার লিখে দেবে কাগজে?

Advertisement

মাথা ঝিমঝিম করে ত্রিশ পেরোনো মেয়েটির। কাগজের চিন্তা চক্কর কাটে যে মাথায়, সেই চুড়িদারের মজুরির কথা ফিরে আসে না। ছেলেটা কাশফুল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। কাশের বনের মধ্যে ধুনোর গন্ধ, ঢাকের বোলে হারিয়ে যান না রেণু, সোমা। দুপুর বেলায় সরকারি কাগজ খুঁজতে বের হতে হয়।

তবু রেণুর একটা ভোটের কার্ড আছে। ওর বান্ধবী সোমা-র কোনও কার্ড নেই। ভোটেরও না, আধারও না। একই বাড়িতে কাজ করেন দু’জনে। রেণু ঘর পরিষ্কার রাখেন, সোমা রান্না করেন। বাড়ি ফেরার সময় রোজ সোমা দু’প্যাকেট দুধ নিয়ে ফেরেন। নাতির জন্য। আজ দুধ আনেনি। ভোটের কার্ড করাতে মিউনিসিপ্যালটি, এসডিও অফিস, বিডিও অফিসে গিয়েছি। টোটো ভাড়ায় খরচ হয়ে গিয়েছে ৬০ টাকা। রেণু বুঝতে পারে, কোনও দুরসম্পর্কের আত্মীয় সোমার বাড়িতেও কার্ড চাইতে গিয়ে থাকবে। টানা আটদিন ধরে কাজে আসে না সোমা। ভোটের কার্ড, আধার কার্ড করাতে অফিসে অফিসে ঘুরছে।

কোথায় পুজো? কোথায় কাশ?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement