ফেরা: জল এসেছে তিস্তাখাতে। জলপাইগুড়িতে। নিজস্ব চিত্র
বাঁধে এসে ধাক্কা খাচ্ছে হাসি হাসি মুখের কোলাহল। মাটির রাস্তা ধরে যতই এগোনো যায় একপাশে ধূ ধূ চর, বাঁধের অন্য পাশে বসতি। উঁচু থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বাঁধের একপাশে বালির চরের গায়ে খসে পড়া আঁচলের মতো লুটিয়ে আছে জলের ধারা। বাঁধের অন্যপাশের মানুষজনের কপালে চিন্তার ভাঁজ নেই, মুখে হাসি। ‘সুন্দরী ফিরে আসছে,’ হাসিমুখে বাবু দাস বলছেন।
জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা সুন্দরী নামেই ডাকে তিস্তাকে। সারা বছর সুন্দরী মাছ দিতো, বর্ষাকালে কাঠ ভাসিয়ে আনত, আর সুখার সময়ে রেখে যেতো পলি ভরা চরের জমি। তাতে চাষ হতো তরমুজ, বাদাম, আলু। বাসিন্দারা বলছেন, পাঁচ বছর আগে এক সুখার সময়ে সুন্দরী তিস্তা চলে গিয়ে আর ফেরেনি। গত পাঁচ বছর খটখটে ছিল চর। চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল পাড়ের বাসিন্দাদের কপালে।
জৈষ্ঠ্যের দুপুরে দেখা মিলল দুলাল রায়ের। জলপাইগুড়ির সারদাপল্লির ওই বাসিন্দার বয়স প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই। জন্ম থেকেই চরের বাসিন্দা হওয়ায় ছোট থেকে দেখেছেন নদীকে। বললেন, “এবার তো তরমুজ, পটল সব মার খেল। জমিতে আগের মতো কারেন্ট নেই।” তিস্তা পাড়ে জন্ম, কথ্য ভাষাতেও ভাটির সুর। পলি মাটি জমে চরের জমির অসীম উর্বরাশক্তিই প্রবীণ দুলাল রায়ের কথায়, ‘কারেন্ট।’ দোমহনী থেকে জলপাইগুড়ি শহর ছুঁয়ে মণ্ডলঘাট-মেখলিগঞ্জ হয়ে তিস্তা গিয়েছে বাংলাদেশে। ভৌগোলিক মানচিত্র অনুসারে এটা তিস্তার ডান দিক। গত পাঁচ বছর ধরে নদীর ডানদিকে জল নেই। চাষবাস হলেও বাসিন্দাদের দাবি, উর্বরাশক্তি কমছিল।
এ বারের বৈশাখে নদী আবার ঘরে ফিরেছে। সরু জলের ধারার মতো বইতে শুরু করেছিল তিস্তা পুরনো পথে। জৈষ্ঠ্যের শেষে এখন টলটলে জল ফিরেছে নদীতে। জলের ধারা ফিরতেই ছিপ, জাল নিয়ে নদীতে ভেসে পড়েছে মাছ ধরা জেলে নৌকা। সন্ধ্যের পরে নদীর পাড়ে দাঁড়াতেই দেখা মিলছে আলোর বিন্দু। কৃষ্ণপক্ষের রাতে সেই আলো দেখিয়ে বাবু দাস বললেন, “শুধু জল নয়। সুন্দরী এ বার মাছও এনেছে অনেক। নদীতে আবার আলো দেখা যাচ্ছে। বহু বছর পরে।”
নিজের জন্ম, ছেলের জন্ম, নাতিরও জন্ম তিস্তা পাড়ে। নদীকে নিয়েই বারোমাস কাটে বাবু দাসের। আগে যখন সারাবছর নদীতে টলটলে জল থাকত তখন মাছ ধরেই সংসারের আয় হতো। সুখার সময়ে চরের জমিতে চাষবাস। গত পাঁচ বছরে সবই ঘুচেছিল। জীবিকা বদলে বাঁধে মুদির দোকান খুলেছেন বাবু। এখন নদীতে জল দেখে ফের নৌকায় পেরেক ঠুকছেন। আবার মাঝ ধরতে বের হবেন তিনি। বর্ষায় আবার আসবে কাঠ।
সেচ দফতরের দাবি, জলপাইগুড়ি শহরে ঢোকার আগেই দূষণের কবলে পড়েছিল নদী। তাতেই জলের গতি হারিয়েছিল। লকডাউনের তিন মাস দূষণ নেই, নদীর জল কোথাও বাধা পায়নি। তাতেই পুরনো পথে বইছে নদী, পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরছেন বাসিন্দারাও। লকডাউনে পরিযায়ী খাত ছেড়ে এ তো নদী-র ঘরে ফেরাই!