প্রচারে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। বুধবার কোচবিহারে হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।
অনেকটা যেন ‘মাস্টারমশাই আপনি কিছুই দেখেননি’র মতো ব্যাপার ঘটছে কোচবিহারে। দিনহাটা, মাথাভাঙা, তুফানগঞ্জ বা কোচবিহার সদর— জেলার এই চার পুরসভায় ভোট-পর্বে শাসক দলের ‘সন্ত্রাসে’ তাঁদের এমনই অভিজ্ঞতা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। ভোট ঘোষণা হওয়ার পর থেকে জেলায় এই ‘আতঙ্ক’ আমদানি করার জন্য তাঁরা এক বাক্যে যাঁর দিকে আঙুল তুলছেন, তিনি জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। রবিবাবু অভিযোগ না মানলেও তৃণমূল সূত্রের দাবি, চার পুরসভায় দলকে জেতাতে না পারলে দলনেত্রীর রোষে পড়ার ভয় রয়েছে রবিবাবুর। তাই ‘আতঙ্কিত’ বলা যায় তাঁকেই।
কোচবিহারে শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগের তালিকা খুব ছোট নয়। তুফানগঞ্জে সপ্তাহখানেক আগে প্রচারে বেরিয়েছিলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী তথা বিদায়ী পুরপ্রধান সুভাষ ভাওয়াল। তাঁর দাবি, মাঝপথে রাস্তা আটকে শাসক দলের কিছু কর্মী-সমর্থক তাঁকে পরামর্শ দেয়, ‘‘কাকু আর প্রচার করবেন না।” প্রবীণ ওই নেতার একাধিক ঘনিষ্ঠ সহচরের কথায়, ‘‘এমন গলায় ওরা কথাগুলো বলল, সে সময়ে ওদের ঠান্ডা চোখ, শক্ত চোয়াল দেখে কথা বাড়াইনি। প্রচার থামাতে বাধ্য হই।’’
সিপিএমের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে ওই পুরসভার ১০ ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডে তাদের প্রার্থীরা প্রচারে বেরোলে শাসক দলের কর্মীরা রাস্তা আটকে দেয়। পুলিশে জানিয়েও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রচার বন্ধ করে ফিরে যেতে বাধ্য হন প্রার্থীরা। মঙ্গলবার রাতে দিনহাটার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মোটরবাইক নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের নির্বাচনী কার্যালয়ে চড়াও ও অফিস ভাঙচুর করাতেও অভিযুক্ত তৃণমূল। সম্প্রতি দিনহাটার ২ নম্বর ওয়ার্ডে ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে প্রচার করছিলেন টিটু দাস নামে দলের এক কর্মী। সে সময় শাসকদলের কর্মীরা গিয়ে তাঁকে প্রচার করতে বারণ করে এবং রাজি না হওয়ায় মারধর করে বলে অভিযোগ। তুফানগঞ্জের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলের ব্যানার লাগানোর জন্য বেরনো বিজেপি কর্মী যুধিষ্ঠির পালের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী প্রফুল্ল পালকে প্রচারের সময়ে হুমকি দেওয়া, মাথাভাঙায় সিপিএমের সভাস্থল থেকে মাইক খুলে নেওয়া, কোচবিহারের একাধিক ওয়ার্ডে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপির ব্যানার, পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগেও জড়িয়েছে তৃণমূলের নাম।
এই সব অভিযোগের সুবাদেই কোচবিহারের অনেক এলাকায় ‘রবি-আতঙ্ক’-এর কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। তার তলায় যেন চাপা পড়ে গিয়েছে পানীয় জল, পথবাতি, পুর-কর, ট্রেড লাইসেন্স, নানা সরকারি ভাতা পাওয়া নিয়ে হয়রানির অভিযোগ। কেন জঞ্জাল সাফাই হয় না, কেনই বা সুষ্ঠু ডাম্পিং গ্রাউন্ড, আধুনিক নিকাশি নালা হয়নি চার পুরসভার অনেক জায়গায়, সে কথাও পিছনে চলে গিয়েছে। বিরোধীরা বলছেন, তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সামনে দলের নেতা-কর্মীদের ভোট করার জন্য প্রশাসনিক এবং অন্য যে সব মদত প্রয়োজন হবে, তার প্রত্যেকটা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিতর্ক বাধানো রবিবাবু স্রেফ ‘আতঙ্ক’ ছড়িয়েই ভোটে জিততে চান।
বিজেপি-র কোচবিহার জেলার সাধারণ সম্পাদক নিখিলরঞ্জন দে, কংগ্রেসের জেলা সভাপতি শ্যামল চৌধুরীদের দাবি, রবিবাবুর বিরুদ্ধে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং জেলা পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। পুলিশের দাবি, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব বলেছেন, ‘‘যেখানে লিখিত অভিযোগ মিলেছে, সেখানে মামলা করা হয়েছে।’’
তবে পুলিশের উপরে পুরোপুরি ভরসা রাখছে না সিপিএম। দলের জেলা-নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী
অনন্ত রায়ের কথায়, ‘‘যে দলের বিধায়ক তথা জেলা সভাপতি
ভোটের সময়ে পুলিশ-প্রশাসন মদত দেবে বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, সেখানে নিরপেক্ষতা আশা করা
উচিত নয়।’’
এই পরিস্থিতিতে বিরোধী শিবিরের নিচুতলার একাংশে আতঙ্ক কমছে না। দিনহাটা, তুফানগঞ্জের একাধিক সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি কর্মী ঘনিষ্ঠদের কাছে সে কথা বলেও ফেলছেন। এঁরা সকলেই ছোটখাট ব্যবসা করেন। তাঁদের আশঙ্কা, ‘‘তৃণমূল জেলায় না জিতলে শান্তিতে ব্যবসা করা যাবে না।’’ সে জন্য তাঁরা নিজেদের দলের মিটিং-মিছিলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
যদিও রবিবাবুর দাবি, হালে পানি না পাওয়ায় বিরোধীরা মনগড়া অভিযোগ তুলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোথায় সন্ত্রাস? রোজই বিরোধী দলের নেতা-প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে। হাসিঠাট্টাও করছি। কাজেই আমি আতঙ্ক ছড়াচ্ছি বলে রটালেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।’’
দলের জেলা সভাপতি এমন দাবি করলেও ‘আতঙ্কের’ প্রসঙ্গ কিন্তু টানছেন তৃণমূলে রবীন্দ্রনাথ-ঘনিষ্ঠদের একাংশ। তবে তাঁদের কাছে সে ‘আতঙ্কের’ অন্য ব্যাখ্যা রয়েছে। ওই তৃণমূল নেতাদের দাবি, দলের প্রদেশ নেতাদের একাংশ রবিবাবুকে পছন্দ করেন না। যে কারণে জেলা থেকে রবিবাবুর অনুমোদিত পুরসভার প্রার্থী-তালিকার অনেক নাম কাটা গিয়েছে।পঞ্চায়েত, বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটে জেলায় দল ভাল ফল করলেও দলেরই কিছু নেতার বিরোধিতায় রবিবাবু মন্ত্রী হতে পারেননি। এ বার কোনও একটি পুরসভা বিরোধীদের দখলে গেলেই দলের অন্দরের সেই বিরোধিতা আরও বাড়বে। তাতে জেলা সভাপতির পদ তো বটেই, বন উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান কিংবা পূর্ত পরিষদীয় সচিবের পদও রবিবাবুর হাতছাড়া হতে পারে বলে ভয় রয়েছে তাঁর অনুগামীদের। ওই তৃণমূল নেতাদের কথায়, ‘‘আতঙ্ক যদি কারও থাকে, তা হলে সেটা রবিদার।’’ রবিবাবু অবশ্য অনুগামীদের এই ‘তত্ত্ব’ খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমাদের লোকেরা যে পরিশ্রম করছেন, তার ফল মিলবেই।’’
যদিও ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহের কটাক্ষ, ‘‘দলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথবাবু কোণঠাসা। তৃণমূলের নিজস্ব মার্কিংয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে অনুব্রত মণ্ডলকে (তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি) নকল করে নিজের জায়গা শক্ত করার চেষ্টায় নেমেছেন। কিন্তু কোচবিহারে হালে পানি মিলবে না।”
ভোটের দিন তোর্সা পাড়ের বৃত্তান্ত যা-ই হোক, ‘আতঙ্কের’ চোরা স্রোত যে তাতে থাকবেই, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট।