নুরজাহান বেওয়া। নিজস্ব চিত্র।
ভুট্টা আর সরষে খেতের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা সিমেন্টের ঢালাই রাস্তা। মাঝে মাঝে আমগাছের সারি যেন ছবির মতো। কিছুটা যেতেই সেই রাস্তার একাধিক জায়গায় সিমেন্টের ঢালাই উঠে গর্তে গাড়ির ঝাঁকুনি। বদলে যাচ্ছে ছবির ক্যানভাস। কুম্ভীরা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ঝাঁটুপাড়ার মুখেই আচমকা ঢালাই উধাও। শুরু এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা। বাঁদিকে কালিয়াচক-৩ ব্লকের বাখরাবাদ পঞ্চায়েতের গণেশ মণ্ডলপাড়া, ডানদিকে ব্লকেরই কুম্ভীরা পঞ্চায়েতের জোত চাঁইপাড়া গ্রাম। ধুলো রাস্তা পেরিয়ে বাঁকের মুখে কিছু বাসিন্দার জটলা। সেদিকেই প্রশ্ন করা গেল, বয়স্করা কি সরকারি ভাতা পান? এক যুবক সামনে এসে বললেন, চলন, আমার মা-কে জিজ্ঞেস করবেন। কাছেই বাড়ি। আনোয়ার হোসেন নামে যুবকটি বাড়ি ঢুকে মা নুরজাহান বেওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাড়ির দাওয়ায় একটি চৌকিতে বসে। জানা গেল, মহিলা স্বামীহীনা। আনোয়ার বললেন, ‘‘আপনার যা জিজ্ঞাস্য, মায়ের কাছে জেনে নিন।’’
প্রশ্ন: বার্ধক্য ভাতা কি পান?
নুরজাহান: ছ’বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছেন। সেই থেকে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসে বিধবা ভাতার আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখনও পাইনি। একবছর আগে ৬০ বছর হয়েছে। বার্ধক্য ভাতার আবেদনও করেছি। কিছুই পাইনি।
প্রশ্ন: কোনও অসুবিধে কি হচ্ছে?
নুরজাহান: সুগার, প্রেসার, শ্বাসকষ্ট-সহ একাধিক রোগ শরীরে বাসা বেধেছে। ওষুধ কিনতে পারছি না। একমাত্র ছেলে দিনমজুরি করে আমাকে, বউমা ও দুই নাতি-নাতনির মুখে দু-দানা তুলে দিচ্ছে। ভাতা পেলে অন্তত ওষুধের খরচ উঠত।
প্রশ্ন: কাউকে জানাননি?
নুরজাহান: পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে গ্রাম প্রধানকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু ফিরেও তাকান না তাঁরা। এখন খোদাই ভরসা।
প্রশ্ন: ‘দুয়ারে সরকারে’র শিবিরে আবেদন করেননি?
নুরজাহান: সেটা আবার কী? কিছু জানি না তো! পঞ্চায়েত সদস্যরাও তো বলেননি কিছু।
তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগোতেই দেখা গেল, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরী লিলুফা খাতুনকে নিয়ে রাস্তার পাশেই বাবা হুমায়ুন শেখ।
প্রশ্ন: মেয়েটির প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট আছে? ও কি মানবিক ভাতা পায়?
হুমায়ুন: দালাল ধরে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করে মালদহ মেডিক্যাল থেকে প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট পেয়েছি মাস কয়েক আগে। মানবিক ভাতার আবেদনও করেছি মাস ছয় আগেই। কিন্তু কোনও খবর নেই।
আর একটু এগিয়ে একটা বাঁকের পর ঘোষপাড়ায় বাড়ির সামনেই বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব লালমণি ঘোষ।
প্রশ্ন: সরকারি ভাতা পান?
লালমণি: পঞ্চায়েত জানিয়েছিল, তফসিলি জাতিভুক্ত ছাড়া সেই ভাতা কেউ পাবে না। পাঁচ বছর আগে বিধবা ভাতার জন্যও বলেছিলাম। কাজ হয়নি। মরলে হয়তো ভাতা দেবে!
প্রশ্ন: ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পে আবেদন করেননি?
লালমণি: এমন সরকারের নাম তো শুনিনি জন্মেও। কী হয় সেখানে?
ওই গ্রামেই নারায়ণ ঘোষের বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, বাঁশের বেড়া ঘেরা আর মরচে ধরা টিনের চাল। রান্নাঘরে খড়ের ছাউনি। তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা ঘোষ মাটির উনুনে জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্না করছেন। বাড়ির কাছেই ইট দিয়ে প্রতিবেশীর একটি পাকা ঘর উঠছে।
প্রশ্ন: ‘বাংলা আবাস যোজনা’য় ঘর পাননি?
নারায়ণ: তালিকায় নামই উঠছে না। ঘর পাব কীভাবে? পঞ্চায়েতকে বলেও লাভ হয়নি।
প্রশ্ন: এলাকায় তো বিজেপির নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য। উজ্জ্বলা গ্যাস মেলেনি?
সন্ধ্যা: অনেক বলেছি। আবেদনও করেছিলাম। এখনও পাইনি। কিছুদিন আগে ফের আবেদন করেছি। পাব কি না জানি না। তাই ভরসা মাটির উনুনই।