কাঠকুটো জ্বেলেই রান্না। সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের ত্রাণশিবিরে ছবিটা এমনই। — হিমাংশুরঞ্জন দেব
কারও ঘরে চাল নেই, তো কারও ঘরে কেরোসিন তেল। সব্জি পাতে পড়ে না বহু দিন। কারও স্টোভ আছে, কিন্তু তা জ্বালানো যায় না। তাই অগত্যা মাটিতে ইট পেতে উনুন। গাছের পাতা কুড়িয়ে ওই উনুনেই হাড়ি চড়াচ্ছেন তাঁরা। আশপাশ থেকে জোগাড় করছেন একটু কলাইয়ের শাক। তাই দিয়েই চলছে দুপুরের খাওয়া।
একঝলকে এটাই ত্রাণশিবিরে বসবাসকারী সাবেক ছিটমহল। সাকিন, দিনহাটার কৃষিমেলা বাজার। আর সেই ত্রাণশিবির বোঝাই নানা অভিযোগ।
যেমন বলছিলেন জরিনা বিবি, সহিদা বেগমরা— “পরিবার পিছু খাবার দেওয়া যা চাল, ডাল, তেল, নুন দেওয়া হচ্ছে, তাতে বড় পরিবারগুলোর দশ দিনও যাচ্ছে না। মাসের বাকি দিনগুলো আধপেটা খেয়েই থাকতে হচ্ছে!’’
যেমন বলছিলেন একাদশী অধিকারী, কৃষ্ণ অধিকারী, নারায়ণচন্দ্র বর্মনরা— “পরিবার পিছু একটা করে একশো দিনের কার্ড দেওয়া হয়েছে। তাতে কত টাকা পাওয়া যায়? সেই টাকা দিয়ে একটি সংসার চলে না।”
গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঘেরা ভারতীয় ছিটমহলগুলি থেকে ৯২১ জন বাসিন্দা ভারতে এসেছেন। দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ এবং হলদিবাড়িতে তিনটি ক্যাম্প করে ওই বাসিন্দাদের থাকতে হয়েছে। শুরু থেকেই ক্যাম্প নিয়ে একাধিক অভিযোগে ছিল বাসিন্দাদের। এখানকার ঘরগুলোয় চার বা তার বেশি লোকের একসঙ্গে থাকাটা খুবই কষ্টের। ডিসেম্বরে প্রশাসনের তরফেই রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয় বাসিন্দাদের। ওই খাবার নিয়েও বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। চলতি মাস থেকে আবার বাসিন্দাদের মধ্যে রেশন সরবরাহের কাজ শুরু করে প্রশাসন। প্রশাসন সূত্রের খবর, একটি পরিবারের জন্য মাসে ৩০ কেজি চাল, পাঁচ কেজি ডাল, পাঁচ কেজি সর্ষের তেল, পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল, একটি এক কেজির গুড়ো দুধের প্যাকেট এবং দু’কেজির দুটো নুনের প্যাকেট বরাদ্দ করা হয়েছে। একটি স্টোভও দেওয়া হয় তাঁদের।
ওই রেশন হাতে পাওয়ার পর থেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, রেশন বরাদ্দের সময় পরিবারের সদস্য সংখ্যার কথা মাথায় রাখেনি প্রশাসন। অনেকেরই বক্তব্য, এই ত্রাণশিবিরে যেমন একা থাকছেন কেউ কেউ, আবার ১০-১২ জনের পরিবারও রয়েছে। সকলকেই যদি মাসে একই পরিমাণ চাল-ডাল দেওয়া হয়, তা হলে বড় পরিবারগুলোর চলবে কী করে?
একাদশী অধিকারী বলেন, “আমার পরিবারে ন’জন সদস্য। ওই খাবার দিয়ে চলবে কী ভাবে?” জরিনা বিবির আবার আর এক সমস্যা। বলছিলেন, “আমার সংসারে ১২ জন আছে। দেওয়া হয়েছে একটা স্টোভ। তা-ও আবার জ্বলে না। বাধ্য হয়ে ইট দিয়ে মাটিতে উনুন তৈরি করে রান্না করতে হচ্ছে।’’ আর চাল-ডাল? জরিনা বললেন, ‘‘অর্ধেক মাসও কাটেনি, আমাদের চাল শেষ হয়ে গিয়েছে!’’ সহিদা বেগম বলছিলেন, “এই চাল-ডালে কুলোয় না। তাই এদিক–ওদিক ঘুরে একটু কলাই শাক জোগাড় করি। তা দিয়েই খাই।” পাঁচ লিটার কেরোসিন নিয়েও একই
ওই ত্রাণশিবিরেরই বাসিন্দা পরেশ বর্মন, মহম্মদ মিজানুর, সোনেকা বর্মনদের দাবি— ওই রেশন পরিবার পিছুর বদলে জনপ্রতি দেওয়া হোক। ইতিমধ্যেই বিষয়টি তাঁরা প্রশাসনিক স্তরে জানিয়েছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, ত্রাণশিবিরের বাসিন্দাদের জন্য একশো দিনের কাজের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। সব পরিবারের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে জব কার্ড। তা থেকে যে যা আয় করবেন, তাতেই সংসারের নানা খরচ চালাতে পারেন। বাসিন্দাদের অবশ্য প্রশ্ন, একশো দিনের টাকা দিয়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন চলা কি সম্ভব? এখন কেউ ১৪ দিন, কেউ ২৮ দিন কাজ করেছেন। ১৪ দিনের কাজের টাকা হাতে পেয়েছেন তাঁরা।
কৃষ্ণবাবু বলেন, “আমার পরিবারে মোট ন’জন। একটা জব কার্ড পেয়েছি। ছ’জন মিলে কাজ করেছি। তাতে ১৬৮ দিন হয়ে গিয়েছে। এখন বলছে টাকা পাব ১০০ দিনের। বাকি টাকা দেওয়া হবে না।” কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “সরকারি যত রকম সুযোগ-সুবিধে আছে, সব দেওয়া হচ্ছে ত্রাণশিবিরে থাকা সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের। তাঁদের দাবিদাওয়া ঊর্ধবতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। কারও যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সে দিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি।’’ (চলবে)