নতুন বিধায়কদের সঙ্গে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকে শুক্রবার মালদহের কেউ ছিলেন না। তাতেই চড়চড় করে মেজাজ চড়েছে তৃণমূল দলনেত্রীর। সেই মেজাজের আঁচ পড়তে চলেছে মালদহের উপরে।
এ দিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মালদহে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীকে বলেছেন, এমন কোনও নেতাকে খুঁজে বার করতে, যিনি গিয়ে মালদহের হাল ধরবেন। অর্থাৎ, মালদহের ভূমিপুত্রদের উপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না মমতা। বাইরে থেকে কাউকে পাঠানো হবে সাবিত্রী মিত্র, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ও দুলাল সরকারের দ্বন্দ্ব সামাল দিতে। শুধু এই তিন জনই নয়, হেরে গিয়েছেন দলের জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনও।
কিন্তু শুধু বিধানসভা ভোটে হারই নয়, তৃণমূলের কাছে আরও উদ্বেগের বিষয় হল, হারের মার্জিন। কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ হেরেছেন প্রায় ৪০ হাজার ভোটে। তাঁকে যিনি হারিয়েছেন সেই জোট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী নীহাররঞ্জন ঘোষ ইংরেজবাজার পুরসভারই কাউন্সিলর। তিনি এক লাখ সাত হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। ওই পুরসভারই চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুবাবু প্রায় সব ওয়ার্ডেই পিছিয়ে রয়েছেন।
একই ভাবে, সাবিত্রী মিত্রও তাঁর মানিকচক কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে এমন সব পঞ্চায়েত এলাকাতেই পিছিয়ে থেকে হেরেছেন। সাবিত্রীদেবীর হারের ব্যবধান ১২ হাজারেরও বেশি ভোট। তবে এই কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে কম। মালদহ কেন্দ্রে দুলালবাবুও ৩৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আর কেন এঁদের রেষারেষি দল মেনে নেবে? তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, এত দিন সাবিত্রীদেবী ও কৃষ্ণেন্দুবাবুর দ্বন্দ্ব মেনে নেওয়া হত এই যুক্তিতে যে, বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের কাছ থেকে কয়েকটি আসনের গ্যারান্টি ছিল। এ বার সেই ভরসাটুকুও যখন চলে গেল, তখন দল কেন এই দু’জনের দ্বন্দ্বের বোঝা টানবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাবিত্রী-কৃষ্ণেন্দু গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ইতিহাস সেই কংগ্রেস আমলের হলেও তার জন্য দলকে এতটা ভোগান্তিতে কখনওই পড়তে হয়নি। মাত্র বছর খানেক আগেই একক ভাবে ইংরেজবাজার পুরসভা দখল করে তৃণমূল। চেয়ারম্যান হন কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ। আর এ বারে এমনকি নিজের ১০ নম্বর ওয়ার্ডেও তাঁর ভোট কমেছে। যার পরে পুরসভার চেয়ারম্যান পদ থেকে কৃষ্ণেন্দুবাবুর ইস্তফা দেওয়ার দাবি উঠেছে দলেরই অন্দরে।
এবং প্রত্যাশিত ভাবেই অন্তর্ঘাতের প্রসঙ্গও উঠেছে। দু’জনেই অতীতে একাধিকবার পরস্পরের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। সরকারি সভাতেও একে অপরের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের অফিসারেরাও দুই মন্ত্রীর বিরোধ নিয়ে বিব্রত ছিলেন। তাতে অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূলও। দলের ভিতরেই কথা উঠেছে, তাঁরা নিজেরা জিততে যতটা সচেষ্ট ছিলেন, অন্যকে হারাতে তার চেয়েও মরিয়া ছিলেন।
যদিও প্রকাশ্যে কেউ কোনও মন্তব্যে নারাজ। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘আমার বলার কিছু নেই। দলনেত্রীর নির্দেশেই আমি পুরসভার চেয়ারম্যান হয়েছি। তাই উনি যা-ই বলবেন তা শেষ কথা।’’ সাবিত্রীদেবীরও বক্তব্য, ‘‘মানিকচকে গত পাঁচ বছরে আমি প্রচুর উন্নয়ন মূলক কাজ করেছি। তার পরেও এমন ফলাফল হল। আর অন্তর্ঘাতের বিষয়ে আমি কিছু বলব না। যা বলার রাজ্য নেতৃত্বকে জানাব।’’
তৃণমূলের দখলে থাকা কাজিগ্রাম, অমৃতি, যদুপুর প্রভৃতি পঞ্চায়েতেও পিছিয়ে রয়েছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। যে পঞ্চায়েত সমিতি একক ভাবে দখল রয়েছে তৃণমূলের, তাতেও ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে ভরাডুবি ঘটেছে তৃণমূল প্রার্থীর। যা নিয়েই দলের অন্দরেই এখন শোরগোল। দলেরই কিছু কাউন্সিলর বলেন, ‘‘এক ব্যক্তি একাধিক ক্ষমতায় থাকার ফলে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন। যার বিরুদ্ধে মানুষ এ বারে রায় দিয়েছেন।’’
এ বার দেখার, মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত থেকে কে ক্ষমতা নেন, তিনি দলকে এ জেলায় কেমন ভাবেই বা ঢেলে সাজান।