সুনামি বলুন, ভূকম্পন বলুন, ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা যাই বলুন—নোট বাতিলের ধাক্কায় অনেকেই কুপোকাৎ দিশেহারা। রক্ত চাপ বাড়ছে। মনখারাপ। চরম হা হুতাশ। অর্থ ছাড়া চলবে কেমন করে? জিলিপির প্যাঁচের মতো কিংবা আঁকাবাঁকা লাইন এটিএমের সম্মুখে। অসীম ধৈর্যের ব্যাপার। আমার সাধ্য নেই লাইনে দাঁড়িয়ে গুঁতোগুঁতি করার। কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পেয়েছি তা দিয়েই চলছে। তারপর নো টেনশন। সেটা ক্যামন?
মাছওয়ালা বলেন, ‘চাচা লে যাইয়ে।’ মুদিওয়ালা বলেন, ‘স্যার যা লাগবে নিয়ে যান।’ মিষ্টির দোকানদার বলেন, ‘যত খুশি নিন।’ ডাক্তার বলেন, ‘আহা, ফিজটা থাকুক।’
এ ভাবে কিছুটা ম্যানেজ করছি। কিন্তু কাজের মাসি। তার চলবে কী করে? কিন্তু টাকা কোথায়? আমি ঘটে পয়সা জমাই। সেটা ভেঙে দেখলাম শ’ পাঁচেক হয়েছে। বাঃ, মন্দ কী? চলুক এক দু’দিন। গিন্নিকে বললাম স্রেফ চালে ডালে ফ্যান ভাত, সেদ্ধভাত। প্রয়োজনে একবেলা উপোস। টোটো, অটো ছেড়ে হাঁটো। কত হাঁটব। বাবু আর দশ টাকা। নে দশ টাকার কয়েন—‘থাক থাক দিতে হবে না। জানেন না দশ টাকার কয়েন চলে না।’ কলো টাকা, সাদা টাকা মোদী-মমতার তর্জা চলছে। প্রধানমন্ত্রীকে তো বাজারের ব্যাগ নিযে ছুটতে হয় না। রেশনকার্ড নিয়ে কেরোসিন জোগার করতে হয় না। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট কেমন করে বুঝবেন?
নোট বাতিলের ধাক্কায় আমজনতাকে সুশীলসমাজ সত্যি লেজে গোবরে। গত কাল ব্যাঙ্কে যাই। আমারই ছাত্র। পাঁচশো-হাজার টাকার গোছাগোছা বাণ্ডিল টেবিলের উপরে। বললাম অর্থ সঙ্কটে পড়ে গিয়েছি। শুনে বলে, ‘লজ্জা দেবেন না স্যার। ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার শূন্য। না থাকলে দেব কী করে? জোনাল অফিস থেকে খবর এসেছে কবে স্বাভাবিক হবে ঠিক নাই। চা খান স্যার।’
অবাক কাণ্ড! আমার অ্যাকাউন্ট থেকে আমার টাকাই তুলতে পারছি না। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। তর্কাতর্কি যুক্তি বিচার বিশ্লেষণ, পাটিগণিতের চুলচেরা বিশ্লেষণ অর্থনীতিবিদ করছেন।
আখেরে না কি জনগণের মঙ্গল হবে। একটু কষ্ট করুন। ভাল কাজের জন্য ত্যাগ স্বীকার করুন। টাকার সন্ধানে বড় ডাকঘরে হাজির হই। সেখানে কুম্ভমেলার মতো ভিড়। চেনা পরিচিত একজনকে খুঁজে বার করি। টাকার প্রসঙ্গ উঠতেই বলে, ‘স্যার লিঙ্ক ফেলিয়র।’
অতএব চলো বাড়ি যাই। পরদিন আবার ব্যাঙ্কে গেলে একখানা গোলাপি রঙের দুই হাজার টাকার নোট পেলাম। পকেটে কিছু দশ বিশ টাকা। বিধানমার্কেটে সব্জি বাজারে বেগুন দেখে লোভ হল। পছন্দ করে দু’খানা গোল বেগুন নিলাম ভাজা খাওয়ার জন্য। সব্জিওয়ালাকে দুই হাজার টাকার নোটটা পকেট থেকে বার করে দেখাতেই বলে, ‘‘কই পামু অত টাকার খুচরা। নিয়া যান। রোজই তো আপনি বাজারে আসেন। পরে দিয়েন।’
কিন্তু সব সময় তো এ ভাবে চলতে পারে না। কত ধার জমাব? তাই অনেক ছোট ছোট সুখ বিসর্জন দিতে হচ্ছে। শীত পড়েছে। এখন কত শাকসব্জি। কিন্তু পকেটে দু’হাজার টাকার নোট নিয়ে সে সব কিনতে যেতে বাধো বাধো ঠেকছে। মোয়া কিনতে গেলে ভাবতে হচ্ছে, এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা কিনি। তা না হলে, কেনাই হচ্ছে না।
সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে কেউ ভাবে না। এখন যা হচ্ছে রাজনীতি। কলো টাকা কত উদ্ধার হল, কেউ বলতেই পারছে না। দুম করে নোট বাতিল ঘোষণা করার আগে মোদী যদি একটু হোমওয়ার্ক করতেন যেমন এটিএম, ব্যাঙ্কের কাজকর্ম কী করে সচল রাখা যায় তা নিয়ে, তা হলে কথা থাকত একটা। কিন্তু চূড়ান্ত আগোছালো এলোমেলো। তারই ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।