ফাইল চিত্র।
জুন মাসের শেষের এক সন্ধ্যা। অফিসে কাজের ফাঁকে ছোট একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখে চোখ প্রায় কপালে উঠল রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার। তাতে লেখা: মায়ানমারের জঙ্গি শিবিরে যাওয়ার সময় ৬ জন সন্দেহভাজন কেএলও জঙ্গি ধরা পডেছে। যার মধ্যে তিন জন রাজ্যের। বা স্পষ্ট করে বললে, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের।
ভাল করে মেসেজ পড়ার মধ্যেই তিনি দেখেন, আলিপুরদুয়ারের জায়গাটার নাম পশ্চিম নারারথলি। চমকে ওঠেন তিনি। জায়গাটি কুমারগ্রাম থানা এলাকায়। যে থানা এলাকায় উত্তর হলদিবাড়িতে এখনও জীবন সিংহের বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। তার থেকে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই থাকে জীবনের দুই কন্যা।
ওই পুলিশকর্তা সঙ্গে সঙ্গে বার্তা পাঠিয়ে দেন নবান্নের শীর্ষমহলে। উত্তরবঙ্গের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অত্যন্ত সতর্ক হওয়ারও নির্দেশ দেন।
পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘এ তো নব্বইয়ের দশক ফেরানোর চেষ্টা। নিজের এলাকার, গ্রামের ছেলেদের প্রশিক্ষণ শিবিরে নেওয়া হচ্ছে। তফাত খালি শিবির পরিচালনায়। আগের বার ছিল আলফা, এ বার এনএসসিএন (কে)।’’
কী ভাবে জানা গেল সেটা? মায়ানমারে ঢোকার আগে নাগাল্যান্ড পুলিশের হাতে যে ক’জন ধরা পড়েন, তার মধ্যে এনএসসিএন (কে) জঙ্গি গোষ্ঠীর এক সদস্য। তাঁকে জেরা করতেই পুরো পরিকল্পনাটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
এটা অবশ্য একমাত্র ঘটনা নয়। জীবন যে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছেন, সেটার আঁচ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। গত বছর সেপ্টেম্বরে কয়েক জন প্রাক্তন কেএলও জঙ্গির সঙ্গে কথা বলার সময়েই জানা যায়, বিশেষ করে আলিপুরদুয়ার জেলায় সমাজমাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে জীবনের ভিডিয়োগুলি। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন করে ‘উৎসাহ’ তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়, বলেছিলেন তাঁরাই।
এর পরে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য পুলিশের এসটিএফের অফিসারেরা সন্দেহভাজন দুই যুবককে পাকড়াও করেন। এঁদের এক জনের বাড়ি কোকরাঝাড়ে, অন্য জনের বাড়ি ফাঁসিদেওয়ায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার, শিলিগুড়ির খালপাড়া এলাকায় কাজ করছিলেন একজন। পুলিশের মতে, উদ্দেশ্য ছিল টাকা তুলে তা দিয়ে বিহার থেকে অস্ত্র কিনবেন। তদন্তে অফিসারেরা নামতেই, তিন মাসের মাথায় ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে ধরা হয় তুফানগঞ্জ কলেজের এক ছাত্রকে। তিনি নাগাল্যান্ড ঘুরে উত্তরবঙ্গে এসে নেপালে যেতে চাইছিলেন। তার পরে জুনে নাগাল্যান্ড থেকে ধরা পড়লেন এই রাজ্যের আরও তিন জন।
অর্থাৎ, ঘুঁটি সাজানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন জীবন। পুলিশ ও গোয়েন্দদের একাংশের মতে, যেটুকু ধরা পড়ছে এবং সামনে আসছে, তা হিমশৈলের চুড়ো।
‘অপারেশন ফ্লাশ আউটে’ জড়িত ছিলেন, এমন দুই পুলিশ অফিসার বলছেন, ‘‘নতুন করে নিশ্চয়ই কোনও ‘সাহায্যে’ই জীবন সক্রিয় হতে চাইছেন।’’ তাঁদের কথায়, ‘‘২০১০-১১ সালের পর থেকে কেএলও-র কোমড় ভেঙে গিয়েছিল বলা চলে। ২০১৯ সাল অবধি কার্যত চুপচাপ ছিলেন জীবন। অসম থেকে টুকটাক খবর আসত। ২০২১ সালের গোড়া থেকে পুরো মাত্রায় সক্রিয় তিনি। কেন এবং কী ভাবে, সেটাই দেখা দরকার।’’
পুলিশ তো বটেই, উত্তরবঙ্গে শিল্পমহলও ভয় পাচ্ছে, এর পরে কি নতুন করে অপহরণ, খুন-জখম এবং টাকা আদায় শুরু হবে? প্রশাসনের মধ্যে থেকে বলা হচ্ছে, আগামী দু’বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। জীবন সিংহের দিক থেকে, উত্তরবঙ্গের দিক থেকেও।
তাঁদের কথায়, ক্ষতি করতে গেলে একটা সহিংস হামলাই যথেষ্ট।
(চলবে)