ঢাক বাজিয়ে তৃণমূলের প্রচারে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। রবিবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
ঝড়-বৃষ্টি আর নেই। ভোটের আগের শেষ রবিবার শিলিগুড়ির আকাশ ঝকঝকে। এপ্রিলের শেষেও বইছে ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস। সব মিলিয়ে ভোটের আগে শেষ রবিবারের আবহাওয়া বড়ই মনোরম। তা বলে পুরভোটের টিকিট না পাওয়া আর পাঁচ জন নেতা-কর্মীর মতো ঘরে বসে ছুটি উপভোগ করার কোনও উপায় নেই গৌতম দেবের!
বরং টিকিট পেয়ে মেয়র পদপ্রার্থী হলে যতটা পরিশ্রম করতে হতো, না পেয়ে তার চেয়ে বেশিই ঘাম ঝরাতে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের উত্তরের সেনাপতিকে! তিনি যে জানেন, একক ভাবে বোর্ড গঠনের ‘ম্যাজিক সংখ্যা’ (৪৭ আসনের বোর্ডে ২৪টি) না পেলে ঘরে-বাইরে তাঁকে নাস্তানাবুদ করার অপেক্ষায় রয়েছেন দলেরই অনেকে। পুরসভা দখল করতে না পারলে তাঁকেই দায়ী করবে দলের অন্দরের একটি অংশ। এমনকী এই প্রশ্নও উঠবে, গৌতমবাবুকে মেয়রপদপ্রার্থী করা হয়নি বলেই কি হোঁচট খেল তৃণমূল?
তাই রবিবার ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত পথে-পথেই কাটাতে দেখা গেল তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতিকে। মুখে একচিলতে হাসি। হেঁটে-হেঁটে দু’হাত জড়ো করে কখনও প্রণাম করেছেন। আবার কখনও হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে বহুতলের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছেন। প্রায় সর্বত্রই সাড়া পেয়ে মুখের হাসিটা চওড়া হচ্ছে। কিন্তু কথা বলার সময় সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, ‘‘অনেক অপপ্রচার চলছে। শিলিগুড়িতে কিছু ওয়ার্ডে ফের ‘রামধনু জোট’ সক্রিয় হতে চাইছে। মানুষ সবই বুঝছেন। সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে আরও বেশি করে সামিল হতে তৃণমূলকে একক ভাবে বোর্ড গঠনের রায় দেবে শিলিগুড়ি।’’
গৌতমবাবু জানেন, শিলিগুড়িতে তৃণমূলের মূল মাথা ব্যথা বামেরাই। প্রচারে বামেরা যে দু’টি মূল প্রশ্ন তুলে ধরছেন, তার জবাবদিহির দায় গৌতমবাবু পুরোপুরি এড়াতে পারেন না। বামেদের প্রশ্ন, কংগ্রেস-তৃণমূল জোট বোর্ড দখল করেও কেন পুরো মেয়াদ চালাতে পারেনি? দ্বিতীয়ত, এসজেডিএ-র বহু কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতির মামলায় এখনও কারও সাজা হল না কেন?
গৌতমবাবুর অনুগামীদের অবশ্য দাবি, এই দু’টি প্রশ্ন মন্ত্রীর অস্বস্তি তো বাড়াতে পারছেই না, বরং সুবিধা করে দিচ্ছে। যেমন পুরবোর্ড সম্পর্কে তাঁদের দাবি, গৌতমবাবুর মেয়র হওয়ার পথে কাঁটা বিছোতে গিয়ে বামেরাই যে শিলিগুড়িতে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল, তা সকলেই জানেন। একই সঙ্গে গৌতম-ঘনিষ্ঠদের দাবি, পুরবাসী এ-ও জানেন যে, বামেদের সৌজন্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের সংখ্যালঘু বোর্ড শহরের উন্নয়ন তো দূরের কথা, স্বাভাবিক পরিষেবাটুকু দিতে গিয়েও হিমশিম খেয়েছে। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘শিলিগুড়িতে কংগ্রেস-সিপিএমের কাণ্ডকারখানা শহরবাসী জানেন। তৃণমূল সরকার রাজ্যে ৪ বছরে কী ভাবে উন্নয়ন করেছে, সেটাও তাঁরা দেখছেন। শুধু তৃণমূলের হাতে পুরবোর্ড থাকলেকী ভাবে রাতারাতি উন্নয়ন হতেপারে, তা গত ছ’মাসে বাসিন্দারা বুঝেছেন। কাজেই শহরবাসীর আশীর্বাদ আমরাই পাচ্ছি।’’
আর বামেদের দ্বিতীয় প্রশ্নটির ক্ষেত্রে মন্ত্রীর অনুগামীদের জবাব, এসজেডিএ-র দুর্নীতি নিয়ে প্রথম সরব হয়েছিলেন গৌতমবাবুই। তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এসজেডিএ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। ভোটের আবহাওয়া যে এখনও গৌতমবাবুর পক্ষে মনোরম, তা বোঝা যাচ্ছে কংগ্রেস এবং বিজেপির হাল দেখে। প্রার্থী বাছাই নিয়ে দলীয় কোন্দলে জেরবার বিজেপি প্রচারের ক্ষেত্রেও অগোছালো। এমনকী, দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া কবে কোথায় প্রচারে যাবেন, তা নিয়েও ঘণ্টায়-ঘণ্টায় ধন্দে ফেলে দেওয়া এসএমএস চালাচালি হচ্ছে! অহলুওয়ালিয়া যদিও দাবি করেছেন, ‘‘সংখ্যা বলতে পারব না। তবে আমরা গরিষ্ঠতা পাওয়ার আশা রাখি।’’ হিসেব বলছে, গত লোকসভা ভোটে বিজেপি শিলিগুড়িতে ২১টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে বিজেপিকে ২টি ওয়ার্ড ছাড়া অন্যত্র তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।
তেমনই কংগ্রেসের অন্দরের খবর, তাঁদের নজর ঘোরাফেরা করছে মূলত গোটা সাতেক ওয়ার্ডে। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকারের কথা থেকেও তা স্পষ্ট। তিনি বলছেন, ‘‘পুরভোটে এমন আসন পাবে কংগ্রেস, যা কি না বোর্ড গড়ার ব্যাপারে ফ্যাক্টর হবে।’’
এই পরিস্থিতিতে গৌতমবাবুর লড়াই দু’দিকে। এক দিকে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামেরা। আর এক দিকে, দলের অন্দরের বিরোধীরা। যতই দোলা সেনের মতো নেত্রী-সাংসদ বারেবারে প্রকাশ্যে ‘গৌতমদা হলেন উত্তরবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং উত্তরে দলের শীর্ষ নেতা’ বলুন, তৃণমূলের অন্দরে তিনি যে সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য নন, তা মন্ত্রী নিজেও জানেন।নিজের রাজনৈতিক জীবনে বারবার কোণঠাসা হয়েও ফিরে এসেছেন গৌতমবাবু। পুরস্কৃতও হয়েছেন। কিন্তু এ বার, ঘরে-বাইরে কঠিন যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। মেয়র পদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যা আছে, তা ধরে রাখাটাও জরুরি। তাই বাইরের আবহাওয়া মনোরম হলেও তৃণমূলের সেনাপতির অন্তরে যে তোলপাড় হচ্ছে, তা মেনে নিচ্ছে দলেরই একাংশ।