‘মৃত্যুপুরী’তে নমুনা সংগ্রহে যাবে ফরেন্সিক দল। —নিজস্ব চিত্র
যত সময় গড়াচ্ছে কালিয়াচক রহস্যের জাল যেন ততই জড়িয়ে যাচ্ছে। মিলছে নানা সূত্রও। ওই কাণ্ডের পাণ্ডা মহম্মদ আসিফের কম্পিউটারে দক্ষতা দেখে পুলিশের সন্দেহ, সে ডার্ক ওয়েবে অস্ত্র কেনাবেচা করত। ঘটনাচক্রে শনিবারই আসিফের দুই বন্ধুর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র এবং বুলেট। তা দেখেই এই ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্তকারীদের মধ্যে। পাশাপাশি উঠে আসছে আরও একটি ভিন্ন তথ্য। কালিয়াচক থানার পুরাতন ১৬ মাইল এলাকাতেই বাড়ি খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে যুক্ত শিক্ষক জিয়াউল হকের। তার সঙ্গে আসিফের কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুরাতন ১৬ মাইলের ওই ‘মৃত্যুপুরী’তে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে ফরেন্সিক দল। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে পারে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-ও। শনিবারই আসিফের দুই বন্ধু, ২০ বছর বয়সি সাব্বির আলি এবং ২২ বছর বয়সি মাহরুফ আলির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৫টি ৭ এমএম পিস্তল পাওয়া গিয়েছে। গুলি পাওয়া গিয়েছে ৮০টি। এ ছাড়াও উদ্ধার হয়েছে ১০টি ম্যাগাজিন। এর পরই আসিফের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ছাড়া অস্ত্র আইনেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া সাব্বির এবং মাহরুফের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে এখনও নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তদন্তকারীরা। তবে মালদহের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া জানিয়েছেন, মূলত সম্পত্তি হাতাতেই বাড়ি সকলকে খুনের ছক কষেছিল আসিফ। তবে তদন্তকারীদের ধারণা, হয়তো ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে অস্ত্র পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়েছিল আসিফ। পুলিশ সুপার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, ৭ থেকে ৮ দিন আগে আসিফ বন্ধুদের অস্ত্র এবং গুলি রাখতে দিয়েছিল। খুন এবং অস্ত্র রাখার সঙ্গে আমরা আপাতত কোনও মিল পাইনি। তবে তদন্ত চলছে। আরও অনেক প্রশ্ন আছে। তা জানার চেষ্টা চলছে।’’
অথচ শনিবার রাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে সকালে আসিফের বন্ধু সাব্বির সাংবাদিকদের আসিফ সম্পর্কে নানা কথা জানায়। বলে, ‘‘আসিফ আমাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত। আমরা পড়াশোনা করেছি, স্কুল গিয়েছি একসঙ্গে। শিক্ষকদের সঙ্গেও ভাল ব্যবহার করত। ও কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। ওর বাবা-মায়ের সম্পর্কে জানতে চাইলে ও খালি বলত, ‘বাবা, মা ভাল আছে’। বাড়ির ভিতরে সুড়ঙ্গটা আসিফই করেছে। ও বলত, ‘একটা গেট করব তাই ভাঙছিলাম’। আমার ভাবতে অবাক লাগছে যে ওই কাণ্ড কী ভাবে ঘটাল। ও আমাদের কোনও দিন গুদামে ঢুকতে দিত না।’’ অপর ধৃত মহম্মদ মাহফুজও একই কথা জানিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছু দিন আগে পিকনিক করেছিলাম ১০-১২ জন মিলে। তবে ওকে দেখে কখনও কিছু সন্দেহ হয়নি। কিন্তু এখন তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ঘটনাটা শুনে মনে হচ্ছে, ওর সঙ্গে আর বন্ধুত্ব রাখা যাবে না। ওপরে ওর নিজের ঘরে কখনও হঠাৎ ঢুকতে দিত না। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সরিয়ে তবে ওই ঘরে ঢুকতে দিত। গুদামে ২৪ ঘণ্টা তালা দেওয়া থাকত। ও ওর বাবা, মাকে মেরেছে। আমরা ওকে কী ভাবে ভরসা করব!’’
তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, খুন আসিফই করেছে। তার দাদা আরিফের ভূমিকা সন্দেহজনক কিছু নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। আসিফের থেকে নগদ ২ লক্ষ টাকার বেশি পাওয়া গিয়েছে বলেও পুলিশসূত্রে জানা গিয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘আসিফ সকলকে বলেছিল ও না কি অ্যাপ বানানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ও বানাতে পারেনি। ওর থেকে প্রচুর বৈদ্যুতিন সামগ্রী মিলেছে। নানা ধরনের কম্পিউটার, বহু মোবাইল ফোন-সহ একাধিক জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে। তাতে কী তথ্য আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ পুলিশ সুপার এও জানিয়েছেন, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পরিবারের সকলকে সুড়ঙ্গ পথে গুদামের মতো দেখতে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল আসিফ। সেখানে ছবি তোলার নাম করে সকলকে আগে থেকে তৈরি করা একটি জলাশয়ে ফেলে খুন করে সে। সেখান থেকে এক মাত্র পালিয়ে আসে আরিফই।