ভাঙন: চা-বাগান ছুঁয়ে ফেলেছে নদী। ময়নাগুড়ির খেমনপাড়া । ছবি: দীপঙ্কর ঘটক
সুপারি গাছটা বছর চারেকের ছোট ছিল হিতেশের থেকে। চার বছর বয়সে সে-ই চারা বুনেছিল। বছর তিনেক আগে নদী যখন উঠোনে ঢুকে পড়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে বাংলা অর্নাসের বইখাতা বগলদাবা করে বাঁচাতে পেরেছিলেন হিতেশ। সুপারি গাছটা নদীই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে তাঁদের ১৫ বিঘা জমি। সব হারিয়ে ময়নাগুড়ির আমগুড়ির খেমনপাড়ার সমৃদ্ধ কৃষক হিতেশের বাবা জ্যোতিষ রায় এখন দিনমজুরির কাজ করেন।
জলঢাকা নদী ধরে উজানের দিকে আরও খানিকটা গেলে দেখা যায় উঁচু চর। ভেলায় ছয় মেয়েকে বসিয়ে দাঁড় টানছেন শ্রীকান্ত মণ্ডল। সারা দিন চরের জমিতে লঙ্কা, পটল আর পাটের দেখাশোনা করে সপরিবার বাড়ি ফিরছেন। জৈষ্ঠ্যের শেষ বিকেলে আকাশ কালো করে বৃষ্টি এল। দশম শ্রেণিতে পড়া বড় মেয়ে বলল, “এ বার আগে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এ বারও মনে হয় বন্যা হবে।” বন্যার কথা শুনে হাসি ফোটে শ্রীকান্তের মুখে। বলেন, “যতবার বন্যা হয়, চরের জমির শক্তি তত বাড়ে।”
ময়নাগুড়ি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল ঘেঁষে ছবির মতো বইছে জলঢাকা নদী। চলার পথে একদিকে খেমনিপাড়ায় হিতেশের বাড়ি, সুপারি গাছ ভেঙে নিয়ে বইছে নদী। অন্য দিকে পাড়ে নাকটানিরবাড়িতে শ্রীকান্তদের জমি ‘শক্ত’ করেছে।
জলঢাকা নদী মাঝখানে উঁচু হয়ে ক্রমশ দু’দিকে সরে এসেছে। আমগুড়ির খেমনিপাড়ার দিকে এতটাই নদী সরে এসেছে যে, বিঘার পর বিঘা কৃষি জমি, বসত বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে। ২০১৬ সালে সেই ঘটনার পর বছরখানেক জমিহারা পরিবারগুলি অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু নদী এক ইঞ্চিও সরে যায়নি। পাট্টা পাওয়া রেকর্ড জমি ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে অন্য ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে প্রায় দেড়শো পরিবার। বদলে গিয়েছে পরিবারগুলির জীবিকাও। পুরো জমি আর চাষবাসের স্মৃতি আটকে রয়েছে শুধু কিসান ক্রেডিট কার্ডের ঋণে।
লক্ষীকান্ত রায় বছর চারেক আগে আলু চাষ করার জন্য কিসান কার্ডে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তার পরের বছরই ফসল শুদ্ধু বেবাক জমি চলে যায় নদীর পেটে। জমিই নেই কিন্তু কৃষিঋণের ভার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে লক্ষীকান্ত, জ্যোতিষ রায়, হরেন রায়দের। জমি না থাকায় কেউ চা বাগানে মজুরির কাজ করেন কেউ বা অন্যের জমিতে শ্রম দেন। তা দিয়েই নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়া জমির ফসল চাষের কিস্তির টাকা শুধোন এখনও। জ্যোতিষ বলেন, “একসময় ১৫ বিঘা জমির মালিক ছিল। এখন কিচ্ছু নেই। সব হারিয়েও এক টাকা ক্ষতিপূরণ পাইনি। কৃষিকাজও আর করতে পারি না। অন্যের জমিতে খাটি।”
উল্টো দিকেও নদী সরেছে। কিছুটা বালিজমি পার হয়ে উঠতে হয় চরে। বছর বছর পলি জমে নদীখাত থেকে চর উঁচু অনেকটাই। নবান্নের ধান থেকে পটল, কচু, লঙ্কা, বাঁধাকপি, ফুলকপি সম্বতসর ফলে। প্রফুল্ল রায় বলেন, “বছর তিনেক আগেও নদী আমাদের দিকেও সরেছিল। উঁচু জমি জল কমলেই নদী নেমে যায়। রেখে যায় পলি। বছরে একবার করে বন্যা আসে। আর পলি জমে।” সেই পলি জমির উর্বরতা বাড়ায়। জলঢাকার চরের ফসলের জন্য মুখিয়ে থাকে ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ির বাজার। ফি বছর শ্রীকান্ত, প্রফুল্লরা অপেক্ষা থাকেন, কবে বান ডাকবে। ঠিক তখনই বন্যার আতঙ্কে রাতজাগে ও পারের খেমনিপাড়া।