ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা। ভারতেই অনুপ্রবেশের দায়ে দু’বছর তিন মাল জেল খাটতে হয়েছে। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের পরে এ বার তিনি ভারতেরই নাগরিক। জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন ১ ডিসেম্বর। ইউনাইটেড কাউন্সিলের উপদেষ্টা দেবব্রত চাকির কথায়, “আমরা খুব খুশি হয়েছি যে, শ্যামল তাঁর নিজের দেশে থাকতে পেরেছেন। এর থেকে কষ্ট তো আর কিছু নেই যে, যে দেশের বাসিন্দা সেখানেই অনুপ্রবেশের অভিযোগে এতদিন জেলে কাটাতে হল।”
কাজের খোঁজেই এক দিন বিএসএফের নজর এড়িয়ে কাঁটাতার টপকে ছিলেন শ্যামল রায়। শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। অনুপ্রবেশের দায়ে জেলের ভিতরে দিন কেটেছে তাঁর। মুক্তির পর আবার বাংলাদেশেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের ফলে সেই ছবিটাই বদলে গিয়েছে আমূল। সেদিনের অনুপ্রবেশকারী শ্যামল এখন এই দেশেরই বাসিন্দা। হলদিবাড়ি ক্যাম্পে পরিবারের সঙ্গে দেখাও হয়েছে তাঁর। কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে শ্যামলের। তাঁর কথায়, “কত কষ্টে দিন কেটেছে। এ বার যদি একটু সুখ পাই।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, সাবেক ভারতীয় ছিটমহল কোটভজানি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন শ্যামল রায়। অনুপ্রবেশের দায়ে জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ছিলেন। মুক্তি মেলার পরে তাঁকে হলদিবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “২০১১ সালের জনগণনায় ছিটমহলের ওই বাসিন্দার নাম ছিল। এ বারে গণনা হওয়ার সময় তিনি জেলে ছিলেন। আমরা সেখানে গিয়ে তাঁর মতামত নিই। এরপরেই এখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়।”
নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “শ্যামলের মতো বহু মানুষকেই বিনা অপরাধে জেলের ভিতরে কাটাতে হয়েছে বলে আমরা মনে করি। একে তো নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন। তার উপর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তাঁদের।”
শ্যামল জানান, সে সময় তাঁর বয়স ১৮। তাঁরা তিন ভাই। বাবা চাষের কাজ করে কোনওরকমে সংসার চালাতেন। এ সময়েই এক ব্যক্তি তাঁকে কেরালায় বাদাম কারখানায় কাজ দেওয়ার আশ্বাস দেয়। অনেক কষ্ট করে কয়েক হাজার টাকা জোগাড় করেন শ্যামল। ওই টাকা দালালের হাতে তুলে দেওয়ার পর একদিন শ্যামলকে কাঁটাতার পার করে দেয় ওই ব্যক্তি। শ্যামলের মতো আরও কয়েক জন ছিলেন সে দলে। কিন্তু হলদিবাড়িতে ঢুকতেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান তাঁরা। সাজা হয় দু’বছর তিন মাসের। জেলে বসে প্রতিদিনই পরিজনদের কথা মনে পড়ত। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। শ্যামল বলেন, “খারাপ কাজ কিছু করিনি। পেটের খিদে মেটানোর জন্য কাজ চেয়েছি। সেই খোঁজেই কাঁটাতার টপকেছি।”
শ্যামল জেল থেকে বেরোনোর কয়েকদিন আগেই তাঁর বাবা নিশিকুমার রায়, মা পুষ্পদেবী, তাঁর আরও দুই ভাই রতন ও তপন চলে এসেছিলেন হলদিবাড়ি ক্যাম্পে। সে খবর পৌঁছে গিয়েছিল শ্যামলের কাছে। তখন দিন গুণতে শুরু করেন তিনি। ১ ডিসেম্বর ক্যাম্পে পৌঁছে চোখের জল আর বাঁধ মানেনি। মা-বাবা দু’জনেই জড়িয়ে ধরেন তাঁকে। প্রতিবেশীরাও জড়ো হয়ে যান। শ্যামল বলেন, “কতদিন মা-বাবা, ভাই কারও সঙ্গে দেখা নেই। এত দিন পর সবাইকে পেয়েছি। আর আলাদা হতে চাই না।”
চোখের জল মুছে পুষ্পদেবী বলেন, ‘‘কবে দেখা হবে ওঁর সঙ্গে সে অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আর ছেলেকে হারাতে হবে না। এ বার আমরা তো ভারতেরই বাসিন্দা।”