সাহু নদীর লাগোয়া এলাকায় পথ চলা দায় দুর্গন্ধে।
অসম থেকে কর্মসূত্রে শিলিগুড়িতে এসেছিলাম ষাটের দশকে। এখন জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। চোখের সামনে শিলিগুড়ির বদলে যাওয়া দেখেছি। অনেক কিছুর পরিবর্তন অনিবার্য। কিন্তু, নদী-নালা-পুকুর-ডোবার চেহারা ক্রমশ রুগ্ণ হয়ে পড়াটা কোনও শুভ পরিবর্তন নয়। মহানন্দা, জোড়াপানি, ফুলেশ্বরীর সংস্কারের অনেক দাবি শুনেছি। তা নিয়ে প্রতিশ্রুতিও ভোটের সময়ে মাইকে শুনি। কিন্তু, শহরের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে য়াওয়া সাহু নদী বাঁচাতে কখনও তেমন আওয়াজ ওঠেনি কেন তা নিয়ে ভাবি। ইদানীং ডাম্পিং গ্রাউন্ড নিয়ে হইচই তুঙ্গে উঠেছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় তা নিয়ে ধারাবাহিক লেখা পড়ে ভাল লাগছে। এতে যদি প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে তা হলে স্বস্তি পাব। কারণ, সাহু নদীতে শহরের নানা এলাকার আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ওই নদীর ধারেই শহরের নানা প্রান্তের মল ঢেলে ফেলার দৃশ্যও অনেক সময় চোখে পড়েছে। সে জন্য এই সংবাদপত্রের মাধ্যমে ওই নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখার আর্জি জানাচ্ছি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের কাছে।
পরিশেষে সবিনয়ে একটি অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে বিনিময় করতে চাই। তা হল বাম আমলে তৎকালীন এক মন্ত্রীর নাগরিক সভায় গিয়ে শিলিগুড়ির মহানন্দা, ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি নদী দূষণের প্রসঙ্গ তুলে তা রোধ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নদীগুলি আরও দূষিত হয়েছে। হয়তো মন্ত্রী চেষ্টা করেও পারেননি। জনতার রায়ে মন্ত্রি ভোটে হেরেছেন। মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। পরে তৃণমূল জমানায় আরেকজন মন্ত্রীর জনতার দরবারে হাজির থাকারও সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানেও ওই নদীগুলির দূষণের প্রসঙ্গ তুলেচিলাম। সেই সঙ্গে আবর্জনার গ্রাসে যাতে সাহু নদীও দুর্গন্ধময় নালায় পরিণত না হয় তা নিশ্চিত করতে আর্জি জানিয়েছিলাম মন্ত্রীর কাছে। বাম জমানার মন্ত্রী যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রায় সেই সুরই শুনেছিলাম তৃণমূল আমলের মন্ত্রীর মুখেও!
নদীর ধারে এ ভাবেই জমছে জঞ্জাল।
তার পরে অনেক মাস কেটে গিয়েছে। সাহু নদী জঞ্জালে ভারাক্রান্ত হয়ে ক্রমশ স্রোত হারাতে বসেছে। মনে রাখা দরকার, শিলিগুড়ির গা ছুঁয়ে থাকা সাহু নদী গতি হারালে কিন্তু বৈকুণ্ঠপুরের বনাঞ্চলের উপরে বিশাল প্রভাব পড়বে। জীবনের শেষার্ধে দাঁড়িয়ে নয়া প্রজন্মের প্রতি আমার আর্জি, সাহু বাঁচাতে কমিটি গড়ে ফেসবুক সহ নানা সোসাল নেটওয়ার্কে জনমত গঠন করা হোক। তাতে যদি টনক নড়ে প্রশাসনের। প্রতিশ্রুতি রাখতে আসরে নামতে বাধ্য হন জনপ্রতিনিধিরা।
নবীন বড়ুয়া, চম্পাসারি, শিলিগুড়ি
মাছেরা কথা বলতে পারে না, তাই নদী ভরে জঞ্জাল?
প্রতি শীতেই আমরা বন্ধুরা মিলে শিলিগুড়ির কাছে শালুগাড়া এলাকায় সাহু নদীর ধারে পিকনিকে যাই। বন অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গেলে নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিত থাকে। চলতি শীতেও পিকনিকে গিয়ে সাহু নদীর চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছি। নদীর ধারে অনেক জায়গায় সাদা বালি আর নেই। দিনের পর দিন জঞ্জাল, মলমূত্র জমা করলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সরে পড়েছি। আগের বার নদীতে গিয়েছিলাম অনেক মাছেরা খেলে বেড়াচ্ছে। এ বার মাছ কোথায়? যে কচিকাঁচাদের আগে দেখতাম মাছ ধরতে, তাদের প্রশ্ন করে শুনলাম মাছ এখন আরও গভীর জঙ্গলের নদীর মধ্যে চলে গিয়েছে। ওই ছেলেগুলির মধ্যে এক জন আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিল যার উত্তর দিতে পারিনি। তা হল, ‘‘দিদি, আপনাদের বাড়ির সামনে কেউ রোজ জঞ্জাল ফেললে তো চেঁচামেচি করবেন। মাছেরা তো কথা বলতে পারে না। তাই ওদের বসবাসের জায়গায় কেউ রোজ মলমূত্র ফেলে দিলেও কোনও হইচই হচ্ছে না। আপনারা শহরের লোকজন কেন চেঁচামেচি করেন না?’’ সে দিন কোনও জবাব দিতে পারিনি। ‘আমার শহর’-এ ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জন্য কী ভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে তা পড়তে গিয়ে সে সব কথা মনে পড়ে গেল। তাই সকলের সামনে সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিলাম। জানি না, পুরসভা-প্রশাসন কী করবে? তবে নদীর হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে আমাদেরই। না হলে সাহু নদীও একদিন স্মৃতি হয়ে যাবে।
তানিয়া ঘোষ, ইস্টার্ন বাইপাস, শিলিগুড়ি
ছবি: সন্দীপ পাল ও বিশ্বরূপ বসাক।