নদীগর্ভে মেচপাড়ার শ্রমিক মহল্লা। ফাইল চিত্র।
টানা বৃষ্টির জেরে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায়। জলপাইগুড়ির কিছু এলাকায় জলঢাকা এবং তিস্তা নদীর জল বিপদসীমা ছুঁয়ে বইছে। জলবন্দি হয়ে পড়েছেন আলিপুরদুয়ারের প্রায় দশ হাজার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে। মৌসম ভবন সূত্রে খবর, আগামী এক-দু’দিন ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে পাহাড় এবং সমতলে।
ভুটান থেকে সিকিম সর্বত্রই টানা বৃষ্টি চলছে। টানা ভারী বৃষ্টি হচ্ছে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকাতেও। যার জেরে পাহাড়ি এলাকা থেকে জল গড়িয়ে সমতলে নামছে। বৃহস্পতিবার রাতে ভারী বৃষ্টির কারণে ফুলেফেঁপে উঠেছে শিলিগুড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা। জলস্তর উঠেছে ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি, সাহু নদীতে। এই অবস্থায় জল-যন্ত্রণার শিকার শিলিগুড়ি পুরনিগমেরও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড। শুক্রবার সকাল থেকেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে ৪, ২৩, ২৫, ২৬ এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা। রাস্তার জল ঘরে বাড়িতে ঢুকে বিপর্যস্ত বহু পরিবার। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে এলাকাবাসী রতন মণ্ডল বলেন, ‘‘গত বছর পুরনিগম বড় বড় কথা বলে গিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এক বছরের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ওদের কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই।’’ শিপ্রা সাহা নামে আর এক বাসিন্দাও বলেন, ‘‘ভোর থেকে জেগে আছি। ঘরের জিনিস বিছানা তুলে রেখেছি। আমাদের এই সমস্যার আর সমাধান হবে না।’’
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে জলপাইগুড়ির বানারহাটে। প্রায় ২৯০ মিলিমিটার। মালবাজারে ১১৩ মিলিমিটার এবং হাসিমারায় ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেচ দফতর জানিয়েছে, তিস্তা জলঢাকা-সহ সব নদীতেই জল বাড়ছে। হাতিনালা উপচে পড়ে বানারহাটে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নাগরাকাটায় ডায়না নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে গ্রামে। জেলা প্রশাসনের তরফে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, “বন্যা দুর্গতদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে, রান্না করা খাবারেরও বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। উদ্ধারের জন্য সব রকম ব্যবস্থা হয়েছে।”
বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আলিপুরদুয়ার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রশাসন সূত্রে খবর, দু’জনের মৃত্যুও হয়েছে। নিখোঁজ এক জন। বুধবার রাতে সমতলের পাশাপাশি, পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টি হয়। যার জেরে, ডুয়ার্সের পাহাড়ি নদীগুলো ফুঁসতে শুরু করে। সকালের দিকে কালচিনির মেচপাড়া এলাকায় পানা নদীর জল ঢুকে আটকে পড়েন প্রায় ৭২ জন বাসিন্দা। তাঁদের উদ্ধারে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং এনডিআরএফের পাশাপাশি, নামানো হয় বায়ুসেনার জওয়ানদের। তৈরি রাখা হয়েছে হেলিকপ্টারও। পরে, প্রশাসনের তরফে তাঁদের প্রত্যেককে উদ্ধারের কথা জানানো হয়। তার আগে, বিপর্যয় মোকাবিলা দলের এক কর্মী জলে ভেসে গেলে, জলে বাঁশ ফেলে কোনও মতে তাঁকে টেনে উদ্ধার করেন কালচিনির বিজেপি বিধায়ক বিশাল লামা। অন্য দিকে, আর এক জনকে হাত দিয়ে টেনে উদ্ধার করেন তৃণমূলের কালচিনি ব্লক সভাপতি বীরেন্দ্র বারা ওঁরাও। এরই মধ্যে জয়গাঁর ঝর্ণা বস্তিতে তোর্সা নদীর জলে তলিয়ে যান সহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এখনও তাঁর খোঁজ মেলেনি। মাদারিহাটের হান্টাপাড়া সংলগ্ন বাঙরি নদীতে হড়পা বানে রুহিনাথ ওরাওঁ (৬৫) নামে এক ব্যক্তি ভেসে যান। পরে কয়েক কিলোমিটার দূরে মুজনাই চা বাগানে মুজনাই নদীর ধার থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। বাঙরি নদীর জলে ভেসে যায় একটা গোটা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রও। মাদারিহাটের সঙ্গে টোটোপাড়া ও হান্টাপাড়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাদারিহাট টুরিস্ট লজও জলমগ্ন হয়ে যায়। আলিপুরদুয়ার-২ ব্লকের ছোটপুকুরিয়া অর্জুনপাড়ায় রাস্তা পার হতে গিয়ে বামনি নদীতে তলিয়ে লালো নাগাসিয়া (৭৫) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। পরে, তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। এ ছাড়া ওই ব্লকের শোভাগঞ্জ, দ্বীপচর জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
জলে প্লাবিত হয় কোচবিহারের তোর্সা নদী লাগোয়া অসংরক্ষিত এলাকা। ঘুঘুমারিতেও নদী ঘেঁষে গড়ে ওঠা বসতি এলাকায় জল ঢুকে পড়ে। তুফানগঞ্জের বালাভূত গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝাউকুঠি এলাকায় কালজানির জলে অসম সংলগ্ন এলাকায় পার বাঁধের একটি অংশ ভেঙে যায়। প্লাবিত হয় অসম সংলগ্ন ঝাউকুঠির একটি অংশ। মেখলিগঞ্জে নদীগর্ভে চলে গিয়েছে চাষের জমি, বাঁশ ঝাড়, সৌরসেচ প্রকল্প, শৌচাগার এবং বিদ্যুতের খুঁটি।
সিকিম আবহাওয়া দফতরের ডিরেক্টর ডক্টর গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘‘দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে লাল সতর্কতা জারি হয়েছে। পাহাড়-সহ সমতলে আগামী এক থেকে দু’দিন ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তার পর বৃষ্টির তীব্রতা কমলেও, বৃষ্টি কমবে না।’’