—প্রতীকী চিত্র।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তবুও ফুটবল পায়ে রাজ্য সড়ক লাগোয়া কালিয়াচকের মোজমপুর মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক দল তরুণ-কিশোর। মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে বার কয়েক চোখ মোছেন চল্লিশোর্ধ্ব। বৃষ্টিতেও তাঁর চোখের জলের রেখা স্পষ্ট। বলেন, “ছেলেটা ঘরে শুয়ে থাকত। স্নান, খাওয়ার কথা বললে মেজাজ নিয়ে তেড়ে আসত। আট মাস নেশামুক্তি কেন্দ্রে ছিল। এখন ওকে খেলতে দেখে, ভাল লাগছে।”
অনেক মাদকাসক্তকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠিয়েছে পুলিশও। মালদহের এক পুলিশ কর্তা বলেন, “ব্রাউন সুগারের নেশার প্রচুর খরচ। সে টাকা বাড়িতে না পেয়ে, অনেকে চুরি-ছিনতাই করে। তাদের গ্রেফতার করে থানায় আনলে নেশার যন্ত্রণা বুঝতে পারি। কারণ, ব্রাউন সুগারের বিষ এক বার কারও রক্তে মিশলে, মস্তিষ্ক তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। নেশা থেকে মুক্তি পেতে অনেককে নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠাতে হয়েছে।” পুলিশ সূত্রের খবর, তেমন বাসিন্দার সংখ্যা কালিয়াচক অঞ্চলে সব চেয়ে বেশি।
অপরাধপ্রবণতার নিরিখে বহু কাল থেকে পুলিশ-প্রশাসনের নজরে রয়েছে কালিয়াচক। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, কালিয়াচকের বাসিন্দাদের একাংশ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। অবৈধ কারবারিরা তাদের সে অভাবের সুযোগ নিয়ে বেআইনি কাজে যুক্ত করে বলে অভিযোগ।
এই কারবারিরা কারা? জেলার এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক বলেন, “বছর তিনেক আগে, ব্রাউন সুগারের কারবারে মূল মাথা বলে মনে করা হয়েছিল মোজমপুরের এক কারবারিকে। এখনও সে জেলে। কিন্তু পরে টের পাওয়া গিয়েছে, তেমন মাথা আরও আছে।’’
কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এখনও জেলায় আসতে পারেন না মোজমপুরের স্বঘোষিত ‘বাদশা’ আসাদুল্লা বিশ্বাস। রাজ্যে পালা বদলের পরে, তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তিনি না থাকলেও, এ বারও পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গ্রাম পঞ্চায়েত, তিনটি পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের জয় হয়েছে। মোজমপুরবাসীর একাংশের দাবি, ‘দাদার (আসাদুল্লা) ইশারা ছাড়া, এলাকায় গাছের একটা পাতাও নড়ে না’। তা হলে ব্রাউন সুগারের মতো কারবার চলছে কী ভাবে? ফোনে আসাদুল্লা বলেন, “এখন সবাই ‘দাদা’। কেউ, কারও কথা শোনে না। আমিও চাই, ব্রাউন সুগারের কারবার বন্ধ হোক।”
এই পরিস্থিতি মাদক-সমস্যা মোকাবিলায় কী করা হচ্ছে? মালদহের পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলেন, “লাগাতার অভিযান চালানো হচ্ছে। ধরপাকড়ের পাশাপাশি, সচেতনতামূলক প্রচারও চলছে।” সিআইডি, নারকোট্রিক কন্ট্রোল বুরোরও (এনসিবি) অভিযান চলছে জেলায়। সিআইডির মালদহের সুপার অনীশ সরকার বলেন, “ব্রাউন সুগারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কিছু সাফল্য পেয়েছি। গ্রেফতার হয়েছে। এখন সে কারবারের বিভিন্ন সংযোগের সুতোগুলো কাটার চেষ্টা হচ্ছে।”
পাশাপাশি, কালিয়াচকের অর্থকরী ফসল রেশম চাষের উন্নতির চেষ্টা হচ্ছে প্রশাসনের তরফে। আম, লিচু উৎপাদনেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কর্মহীন যুবক-যুবতীদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। মালদহের জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়া বলেন, “কালিয়াচকের সুজাপুর লাগোয়া মধুঘাটে শিল্প-পার্ক তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসার জন্য ঋণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।”
বাবা-মার হাত ধরে সদ্য নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরা ‘ক্লিন শেভড’ যুবক অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পুলিশ-প্রশাসনের পাশাপাশি, মাদক নিয়ে ব্যক্তি-সচেতনতার গুরুত্বও। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রাউন সুগারের নেশার ফাঁদে পড়ে পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। জীবন থেকে যেন কয়েকটা বছর হারিয়ে ফেলেছি! পরিবারকে কত কষ্ট দিয়েছি! আমি নেশার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসেছি। যাঁরা মাদকের দিকে হাত বাড়ান, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে চাই, শুধু টাকা নয়, জীবন দিয়েও চোকাতে হয় মাদকের মূল্য।’’ (শেষ)