অনেক দিন ধরে আপনি একটা লেখা লিখতে চাইছেন। হয়তো অনেক দিন নয়। এক দিন, একটা দুপুর, বেশ মরে আসা দুপুর, আপনার মনে হল আপনি কিছু লিখবেন, কিন্তু একটি অক্ষরও লিখতে পারলেন না। কারণ, কী লিখবেন, আপনি জানেন না। বা শেষ রাত। ঘুম ভেঙে আপনি আকাশটা দেখলেন। অদ্ভুত নীল, আপনার মনে হল আপনি লিখবেন, কিন্তু কী লিখবেন, আপনি জানেন না। শুধু ইচ্ছেটা জেগে থাকল, সেই ইচ্ছেতে আপনি ঘুরে বেড়ালেন, গল্প করলেন বা চুপ করে রইলেন, আপনার চারদিকে কত লোকে কত কথা বলে গেল, আপনি শুনলেনও না।
আপনার মনে পড়ল ‘দ্য আওয়ারস’ ছবিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র ক্ল্যারিসা ভন মেয়েকে বলছে, ‘‘একটা ভোরে উঠে মনে হয়েছিল, কত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সকালটাতে, কত কিছু ঘটতে পারে। মনে হল, এটাই আনন্দের শুরু, সুখের সুরু, এর পর আরও কিছু ঘটবে ভাল কিছু, এ ভাবেই শুরু হয় সুখ, আনন্দ, তখন বুঝিনি, ওইটাই, ওই মুহূর্তটা কিছুর শুরু ছিল না। ওইটাই সুখ, ওইটাই আনন্দ, ওইটাই, ওই মুহূর্তটাই সব।’’ ‘ইট ওয়াজ় দ্য মোমেন্ট রাইট দেন’।
ষষ্ঠীর ভোরটা, যখন আলতো করে পাড়ায় একটা ঢাক বেজে উঠেই থেমে গেল, ভোরটা বেশ বেশ ভোর মনে হল আলতো হাওয়া। ওইটাই, ওই মুহূর্তটাই পুজো। কেন তার পর? তার পরও পুজো। আস্তে আস্তে দশমীর দিকে এগিয়ে যাওয়া। অষ্টমীর মাঝ রাত থেকেই কিন্তু মন খারাপ শুরু হয়ে যায়, এই তো শেষ হয়ে যাবে পুজো।
কিন্তু শুরুটাই সব, আসবে, হবে, এই রকম আর কী। শুধু দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিন নয়, পুরো জীবনটাই এই রকম। আসবে, হবে, হতে পারে। মানুষ তো এই নিয়েই বাঁচে। সারা জীবন। হয়তো হল না, হয়তো হবে না, তবু আমরা ভাবি। আমরা বাঁচি। আমাদের আনন্দ জন্ম নেয়।
ওই ক’দিন, যারা পারি আর কী, তারা ভাল করে খাই, সে বড় রেস্তরাঁয় গিয়ে খাওয়াই বলুন বা রাস্তার ধারে চাওমিন-রোল খাওয়াই বলুন, অন্তত একটা ভাল জামা পরি, কেউ হয়তো অন্যের ফেলে দেওয়া একটা পরিষ্কার জামাই পরি। আবার যে পরি না, সে-ও হয়তো মণ্ডপের ধারে লাইন দিয়ে একটু খিচুড়ি ভোগ নিয়ে চেটেপুটে খাই। এই আনন্দকে কেন্দ্র করে একটা বড় অর্থনীতি চলে, কেউ কিছু দিন অন্তত চারবেলা খাওয়ার রসদ জোগাড় করে এ কদিনের খাটুনি থেকে।
এখনও বেলুন বিক্রি হয়, রাস্তার ধারে চেয়ার ফেলে ঘামতে ঘামতে গাদা গাদা চাওমিন, রোল, ফুচকা, সস, আইসক্রিম, ছিঁড়ে যাওয়া জুতো, সেফটিপিন দিয়ে আটকানো ব্লাউজ, জামা, শাড়ি সামগ্রিক আনন্দের জোগান দেয়। সামগ্রিক এবং ব্যক্তিগত।
অথচ, আমাদের চারদিকে কোনও পুজোতেই আনন্দ থাকে না, কোনও বার বন্যা, কোনও বার খরা, কোনও বার করোনা, কোনও বার ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মৃতদেহ, রক্ত, ভয়, আতঙ্ক। সকালবেলা উঠে আপনাকে দেখতে হচ্ছে মৃতদেহের ছবি। শিশুর। গৃহহীনের। ভাঙা ঘর। মানুষের মিছিল। কোনও বার নিজেরই পাড়া। কোনও বার অন্য দেশে। অশান্তি, যার আঁচে আপনার রান্নাঘর পুড়ছে। বা পুড়ছে না।
তবু মানুষ বাঁচে, বাঁচতে হয়। নিজের প্রয়োজনে, অন্যের প্রয়োজনে।
পুজো কাউকে কাউকে হয়তো সেই মুহূর্তটা দেয়। বাঁচার মুহূর্তটা। যে বাচ্চাটা রোজ আপনার গাড়ির জানলায় টোকা দেয় ধূপকাঠি কিনতে, আপনি কোনও দিন কিছু দেন না, পুজোর সময়ে হয়তো দশ টাকাই হয়তো দিয়ে দেন, রেস্তরাঁয় খেয়ে বেরনোর সময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা বাচ্চাগুলোকে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে কিছু দেন, বা আরও ভাল কিছু করেন, যা অন্য কোনও দিনই করেন না। কেন করেন? পুজো কী বাড়তি দেয়? পুজো মনটাকে কি উদার করে দেয়? কিছু ক্ষণের জন্য হলেও দেয় হয়তো।
বাকি সময়ের দুঃখ, স্বার্থপরতা, হিংসা ঢাকা দেওয়ার জন্য পুজো আমাদের কয়েকটা ঘণ্টা দেয়। ‘দ্য আওয়ারস’ ছবিতে তো সেই কয়েক ঘণ্টার কথাই ছিল। অমোঘ কয়েকটা ঘণ্টা, যা কাউকে ঠেলে দেয় রেল লাইনের দিকে, কেউ গৃহ ছাড়ে, কেউ লাশকাটা ঘরে চলে যায়। লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ এই কয়েকটা ঘণ্টার কথাই লিখেছিলেন তাঁর শেষ চিঠিতে, যা তাঁকে তাড়া করে বেড়াত, সৃষ্টিশীল মুহূর্ত, ভাল লাগার মুহূর্ত, তার পরেই সেই কয়েকটা অন্ধকার ঘণ্টা আসবেই।
বিসর্জন আছে বলেই বোধন এবং বোধন আছে বলেই বিসর্জন।
তাই এ-ও সত্য যে জীবনের এত দুঃখ, লড়াই, ঘাম, রক্ত, পরাজয়, সব কিছুর পরও সেই কয়েকটা ঘণ্টা থাকে, যখন শিমুল তুলোর ফল ফাটার মতো ফেটে বেরোয় যা আমরা চেয়েছি, আনন্দ, শান্তি, স্থিতি, একটু সুখ, সাহস, শক্তি। ‘স্টিল উই চেরিশ দ্য সিটি, দ্য মর্নিং, উই হোপ, মোর দ্যান এনিথিং, ফর মোর। হেভন অনলি নোজ়, হোয়াই উই লাভ ইট সো।’
পুজো আমাদের সেই সুযোগ দেয়। দেয় কিছু পাওয়ার। কিছু দেওয়ার। হারিয়েও পাওয়ার। ফিরে আসার।
অন্য দিনও তো দেয় সুযোগটা। দেয় না?
কিছু মুহূর্ত তো থাকেই ষষ্ঠী হয়ে।
যার শিউলি নেই, স্থলপদ্ম নেই, প্রদীপ নেই, ধুনোর ধোঁয়া নেই, ঢাক নেই, প্রতিমা নেই, বিসর্জন নেই।
শুধু ষষ্ঠী হয়ে ওঠা আছে।
ভালবাসার।