ঘটনা ১: বছরখানেক আগে কুমারগ্রামের কাঞ্জালি বস্তিতে বুনোহাতির দল রাতের অন্ধকারে বেশ কয়েকটি বাড়িতে হানা দেয়। মশাল জ্বালিয়ে, পটকা ফাটিয়েও কোনও কাজ হল না। বনকর্মীরা শূন্যে গুলিও ছুড়লেন কয়েক রাউন্ড। তাতেও হাতির কোনও হেলদোল নেই। সকালে হাতির দল নিজের মর্জিতে ফিরে গেল জঙ্গলে।
ঘটনা ২: বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ছিপড়া বনাঞ্চল লাগোয়া গ্রাম ছোট চৌকিরবস। মাস কয়েক আগে সেখানেও রাতদুপুরে কপির খেতে ঢুকে পড়ে একটি দলছুট হাতি। হাতির চোখে সার্চ লাইটের তীব্র আলো ফেলতেই হাতি পালানো তো দূরের কথা, তেড়ে আসে আলোর দিকেই।
ঘটনা ৩: ছোট চৌকিরবস গ্রামে হাতির হানা ঠেকাতে গ্রামের চারপাশে বিদ্যুতের তারের বেড়া দেওয়া হয়। গ্রামের লোকজন ভেবেছিলেন, আর বুঝি হাতি আসবে না। সম্প্রতি সেই ভাবনায় জল ঢেলে হাতি ঢুকে পড়ে গ্রামে। সকালে গ্রামবাসী ও বনকর্মীরা দেখেন, বিদ্যুতের তার না ছুঁয়ে খুটিগুলো উপড়ে দিয়েছে হাতির দল। বেড়াটা পড়ে রয়েছে। আর তারের ফাঁকে পা রেখে গ্রামে ঢুকে পড়ে হাতি।
বনকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এক দশক আগেও কিন্তু বুনো হাতির এমন স্বভাব দেখেননি তাঁরা। তখন গ্রামে হাতির আনাগোনাও অনেক কম ছিল। আচমকা জনবসতি এলাকায় বুনো হাতি চলে এলে মশাল জ্বালিয়ে ‘বাবু হটো, বাবু হটো’ (ডুয়ার্সের জঙ্গল লাগোয়া বাসিন্দারা হাতিকে বাবু বলেন) বলে চিৎকার করলেই হাতি জঙ্গলে ফিরে যেত। কিন্তু এখন ‘বাবু’ আর সে কথায় কান দিচ্ছে না। মশাল, পটকা, সার্চ লাইটের তীব্র আলো, এমনকি বন্দুকের গুলির আওয়াজেও লোকালয়ে আসা হাতি আর জঙ্গলমুখো হচ্ছে না। অথচ একটা সময় মশাল জ্বেলে হল্লা করলেই হাতি পালাত।
বন কর্তা ও পরিবেশকর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, খাবারের জন্য মরিয়া হয়েই বুনো হাতির স্বভাবে এমন পরিবর্তন। পানবাড়ি গ্রামের ঝুনু সরকার বলছেন, ‘‘জঙ্গলের কাছেই আমার বাড়ি। আট-দশ বছর আগেও হাতি মাসে এক বারও লোকালয়ে আসত না। এখন হাতির হানা রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
আলিপুরদুয়ার পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের চেয়ারম্যান অমল দত্তের দাবি, কাঠচোরদের দৌরাত্ম্যে সাফ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল। যেটুকু রয়েছে সেটাও রক্ষা করতে পারছে না বন দফতর। ফলে বুনো জীবজন্তুদের খাবারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে জঙ্গলে। আর সেই কারণেই খাবারের খোঁজে প্রতি রাতে দলবেঁধে বুনোহাতি গ্রামে ঢুকে ফসল নষ্ট করছে। ঘরবাড়ি ভাঙছে। হাতির হাত থেকে ফসল বাঁচাতে জমির চারপাশে বেআইনি ভাবে বিদ্যুতের তারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় হাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাও যাচ্ছে। মানুষ গাছ কেটে জঙ্গলের ক্ষতি করেছে, হাতি এখন তারই বদলা নিচ্ছে। জঙ্গলে অবৈধ অনুপ্রবেশ চলছে, ঢুকছে গবাদি পশু। গাড়ি চলাচল করছে। ফলে হাতির স্বভাবও বদলে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘আগের ঘন গভীর জঙ্গল এখন আর নেই। হাতির খাবারের চরম অভাব রয়েছে। জলের উৎসগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে খাবারের খোঁজে হাতি লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে। জঙ্গলের পরিধি কমছে। আইন ভেঙে হাতির কড়িডরগুলো বন্ধ করে বসতি, রিসর্ট, হোম স্টে গড়ে তোলা হচ্ছে।’’