ফাইল চিত্র।
কেএলও-র জন্ম হয় গিয়েছে দু’বছর আগে। অথচ, সেই তথ্য জানাই ছিল না খোদ জীবন সিংহের তখনকার ছায়াসঙ্গীর! বরং তাঁর দাবি, তিনি নাকি শুরুতে জীবনকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন অস্ত্র হাতে তুলে না নিতে! তবে তাঁর পরামর্শ যে টেকেনি, সেটা তো পরের কয়েক বছর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু কেন জীবন এই পথে নেমেছিলেন?
আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রাম থানা থেকে সামান্য দূরে উত্তর হলদিবাড়ি। সেখানেই জীবন সিংহের বাড়ি। এবং গোটা রাজ্যে সেই এলাকাতেই সম্ভবত তাঁর প্রভাব সব থেকে বেশি। এখানে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন প্রাক্তন কেএলও জঙ্গিরা। কেউ তাঁর ছায়াসঙ্গী, কেউ আত্মীয়। সকলেই কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে চাইছেন, জীবন সেই সময়ে পরিস্থিতির শিকার। কী রকম?
জীবনের সেই আত্মীয় গল্পের মতো করেই বলেন, ‘‘হত দরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলেন জীবন। তবে নিজের চেষ্টা পড়াশোনা করেছিলেন। এলাকায় ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিতিও ছিল। একটা সময়ে গৃহশিক্ষকতাও করতেন।’’ কোন বিষয় পড়াতেন তিনি? আত্মীয় জানালেন, ইংরেজি। তিনি বলতে থাকেন, ‘‘বাম আমলে সিপিএম থেকে আরএসপি, সব নেতার দোরে দোরে ঘুরেও একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেননি জীবন। এখন যে নেতাদের কেউ কেউ রাজ্যের শাসকদলেও রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে জীবনের মা মধ্যরাত পর্যন্ত চিঁড়ে ভাঙিয়ে সকালে হাটে বিক্রি করতে যেতেন। তাতেও সংসার চলত না। তখন জীবন সঙ্কোশ চা বাগানে পাতা তোলার কাজও শুরু করেন।”
সে সব নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। জীবনের ছায়াসঙ্গী বলছিলেন, “সেই সময় বাড়ির সকলে বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু আমি আকসু-র (অল কামতাপুর স্টুডেন্ট ইউনিয়ন) দিকেই গিয়েছিলাম। আমাদের একই এলাকার বাসিন্দা জীবনকে তখন আকসু-র উত্তরবঙ্গের আহ্বায়ক হিসাবেই চিনতাম। খুব দ্রুত আকসু-তে নিজের জায়গা করে জীবনের নজরেও পড়েছিলাম। কিন্তু বাম আমলের পুলিশ আমাদের নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলারও সুযোগ দিত না। সভা করলেই আমাদের উপর অত্যাচার হত। সিপিএমের লোকেরাও এসে পেটাত।”
সিপিএমের আলিপুরদুয়ার জেলা সম্পাদক কিশোর দাস অবশ্য বলেন, “নেতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাকরি পাওয়া যায় না। তার জন্য একটা পদ্ধতি রয়েছে। ফলে এটা কোনও অভিযোগ হতে পারে না।”
জীবনের ছায়াসঙ্গীটি জানালেন, এই সময়েই পটবদলের শুরু। এক দিন জীবন এসে তাঁকে বোঝান, কেন হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া জরুরি। সঙ্গীটি তাতে চমকে যান। তিনি পাল্টা জীবনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভারতের মতো উন্নত সামরিক দেশে অস্ত্র হাতে তাঁরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জীবনের পথেই এগোতে হয় তাঁর সেই ছায়াসঙ্গীকে। তিনি বলেন, “১৯৯৫ সালের শেষ দিকে আমরা একসঙ্গে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাই। তখন জানতে পারি, দু’বছর আগেই কেএলও গঠন করে ফেলেছেন জীবন।”
সেই সশস্ত্র লড়াই জীবনকে নিয়ে গিয়েছে দেশের বাইরে। শেষ দেখা হয়নি বাবা, মায়ের সঙ্গে। জীবনের মা যখন মারা যান, রটে গিয়েছিল, একবারের জন্য হলেও আসবেন জঙ্গি নেতা। চারপাশ সাদা পোশাকের পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল, আজও বলেন পড়শিরা। কিন্তু সেই ‘ভুল’ করেননি বুদ্ধিমান জীবন।
তাঁর নিকটাত্মীয়টি শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কিত। তিনি বলেন, ‘‘স্ত্রীকেও শেষ দেখা হয়নি জীবনের।’’ যদিও জেলার আনাচ কানাচ থেকে শোনা যায় অন্য কথা। বলা হয়, জীবনই নাকি স্ত্রী ও মেয়েদের পাঠিয়েছিলেন শিলিগুড়িতে। কারণ, বিশ্বাস ছিল, সেখানে গেলেই একমাত্র রক্ষা পাবে মেয়েরা। যা হোক কিছু চিকিৎসা হবে স্ত্রীয়ের। যদিও জীবন-পত্নীকে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকেরা। কিন্তু মেয়েরা ভালই আছে। পড়াশোনা স্থানীয় স্কুলে।
আর এর মধ্যে জীবন কি তৈরি হচ্ছেন বাংলা ভাগের দাবিতে ফের উত্তরবঙ্গের এই অংশকে উত্তপ্ত করতে?