কন্যাশ্রী যোদ্ধা ঈশিকা। বংশীহারিতে। নিজস্ব চিত্র।
মনের গোপন কথা কাগজে লিখে ক্লাসঘরের কোণে রাখা বাক্সে জমা করত পড়ুয়ারা। একদিন দিদিমণি বাক্সে পেলেন একটি চিরকুট। লেখা, ‘দিদিমণি, কাউকে বলো না, আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে।’ দিদিমণি ছুটলেন সেই ছাত্রীর বাড়িতে। বিয়েটা আটকানো গিয়েছিল সে যাত্রায়। দিদিমণিও রোজ ক্লাসে এসে বলতেন, “পড়া শেষ না করে কেউ বিয়ে করবে না। বাড়ি থেকে জোর করলে আমাদের জানাবে।” করোনার আবহে বছর দেড়েক স্কুল বন্ধ। বন্ধ ক্লাসঘরও। ঘরের কোণে রাখা বাক্সটিও আর নাগালে নেই ছাত্রীদের। এ বারে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ভরতে গিয়ে দিদিমণি শোনেন, তাঁর ক্লাসের আটটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া বিবেকানন্দ হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির শ্রেণির শিক্ষিকা সুমনা ঘোষদস্তিদার বলেন, “শুনেছি এক ছাত্রী নাকি সন্তানসম্ভবা। আঠারোই তো হয়নি ওর। ওদের পড়াশোনার কী হবে?”
স্কুলে স্কুলে কন্যাশ্রী যোদ্ধা, স্বয়ংসিদ্ধার দল ছিল। সহপাঠীর বিয়ে হচ্ছে খবর পেলে বান্ধবীরা দল বেঁধে গিয়ে আটকে দিত। এমন অসংখ্য নজির ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গে। শিলিগুড়ির খড়িবাড়ি তারকনাথ সিন্ধুবালা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সঞ্চিতা সরকার বলেন, “স্কুলই তো বন্ধ। মেয়েদের দল তাই একজোট হয়ে কাজ করতে পারছে না।” দক্ষিণ দিনাজপুরের বংশীহারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ঈশিকা গোস্বামী কন্যাশ্রী ক্লাবের সদস্য। সে বলে, “স্কুলে রোজকার আলোচনা, গল্পে আমরা ঠিক খবর পেয়ে যেতাম, কারও বিয়ে ঠিক হচ্ছে কিনা। সেই খবর আমরা শিক্ষিকাদের দিতাম।’’
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, কোচবিহারের নাজিরহাটে এক অভিভাবকের কথাতেই তার ইঙ্গিত মিলে গেল। তিনি বলেন, ‘‘এক বছর ধরে স্কুল বন্ধ, মেয়েটা বাড়িতে বসে কী করবে! মাসে মাসে মোবাইলে চারশো টাকা ভরে পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। গেলবার আলুর টাকা ঘরে ছিল, তাই দিয়ে বিয়ে দিয়েছি।”
মালদহের প্রশাসন ও স্কুল সূত্রে খবর, স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্রীদের উপর শিক্ষকদের নজরদারি সে ভাবে ছিল না। ফলে বিয়ের ঘটনা বেড়েছে। এবং কিশোরীদের মধ্যেই বেশি। এদের মধ্যে যে কিশোরীদের উদ্ধার করা গিয়েছে, তাদের শিশু সুরক্ষা কমিটি কাউন্সেলিং করে হোমে রেখেছে। মালদহের দাল্লা চন্দ্রমোহন বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক জয়দেব লাহিড়ি বলেন, ‘‘স্কুল খোলা থাকলে আমাদের নজরদারি থাকে। আগে আমাদের ছাত্রী এবং শিক্ষকরা অনেক বাল্যবিবাহ রুখেছেন।’’ জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটির চেয়ারপার্সন চৈতালি ঘোষ সরকার বলেন, “বেশ কিছু বাল্যবিবাহের খবর আমরা পেয়েছি। কিশোরীদের উদ্ধার করে কাউন্সেলিং করে হোমে পাঠিয়েছি।’’ কাউন্সেলিং কেন্দ্র থেকে মেয়েরা কি স্কুলে ফিরতে পারবে, উত্তর নেই
কারও কাছে।
আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় গিয়ে রাজ্যস্তরে কন্যাশ্রী পুরস্কার পেয়েছিল জলপাইগুড়ির দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। প্রিয় কবিতা ‘দুঃসময়’। ‘তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর’ বলার সময়ে তার উদাত্ত কণ্ঠে হাততালি পড়েছে প্রতিবার। সেই মেয়েটিরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তবু তাকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে অনুরোধ করেছিল স্কুল। মেয়েটি বলেছে, “জানি না পারব কি না। সবে শ্বশুরবাড়িতে এসেছি। আগের মতো আর নেই।”
তাকে দিদিমণিরা বলেছেন, “আবৃত্তিটা ছেড় না।’’
(প্রতিবেদন: নমিতেশ ঘোষ, জয়ন্ত সেন, নীতেশ বর্মণ, অনির্বাণ রায়, নীহার বিশ্বাস)