সন্তর্পণে: কার্ফুর শহরে ঘর থেকে সাবধানে উঁকি খুদের। বালুরঘাটে। ছবি: অমিত মোহান্ত
কোথাও মসজিদের আজানের সুর, কোথাও মন্দিরের পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে ভাঙল ঘুম। ভোরের নিস্তব্ধতা ভাঙল কোকিলের ডাক। কিন্তু অন্য দিনের মতো শোনা গেলে না গাড়ির হর্ন। শোনা গেলে না আনাজ, দুধ বিক্রেতাদের হাকডাক।
রবিবারের সকালে এমনই অচেনা ছবি ধরা পড়ল গৌড়বঙ্গের তিন জেলা— মালদহ ও দুই দিনাজপুরে। করোনা-মোকাবিলায় ‘জনতা কার্ফু’তে রাজপথ থেকে অলি-গলি সবই দিনভর থাকল কার্যত ‘মানবশূন্য’। নিঝুম, নিস্তব্ধতার তাল কাটে বিকেল হতেই। শহর থেকে গ্রাম। তিন জেলায় বেজে উঠল কাঁসর, ঘন্টা, শঙ্খ।
মালদহ
ইংরেজবাজার: ইংরেজবাজার শহরের কোঠাবাড়ি মসজিদ। রবিবার ভোরের আজানের সুর স্পষ্ট কানে ভেসে এল এক কিলোমিটার দূরের সুকান্ত মোড়ে। সেখানেই পৌঁছে গেল ৩০০ মিটার দূরের মনস্কামনা মন্দিরের পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণও। অথচ, সুকান্ত মোড় দিয়েই গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাতভর যানবাহন চলাচল করে সেই সড়ক দিয়ে। যানবাহনের শব্দে নাজেহাল হন স্থানীয় বাসিন্দারা। জনতা কার্ফুর দৌলতে অবশ্য এ দিন গাড়ি নয়, আজানের সুর, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে ঘুম ভাঙল অনেকের। শুধু সুকান্ত মোড় নয়, বিনয় সরকার রোড, গৌড় রোড, মকদমপুর রোড এলাকাতেও। এ দিন ঝাঁপ বন্ধ ছিল শহরের সব বাজার, দোকানের। রাস্তাঘাট ছিল সুনসান।
চাঁচল: চাঁচলের প্রাণকেন্দ্র নেতাজি মোড়। ভোর ৪টে বাজতেই প্রতি দিন চায়ের দোকানের ঝাঁপ খুলে যায়। দূরপাল্লার বাসের শব্দে ভাঙে ভোরের নিস্তব্ধতা। রবিবার তা ছিল না। এ দিন গাড়ি বা চায়ের দোকানের শব্দে নয়, ঘুম ভাঙল পাখির কলতানে। একই ছবি ছিল, হরিশ্চন্দ্রপুর, সামসি, রতুয়া পুরো চাঁচল মহকুমায়। করোনা-রুখতে ‘জনতা কার্ফু’ যেন হার মানাল যে কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধকে। জরুরি প্রয়োজনে সাইকেল, বা হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছলেন অনেকে।
দক্ষিণ দিনাজপুর
বালুরঘাট: ২৪ ঘণ্টা আগেও বালুরঘাটের বিভিন্ন মোড়ে চায়ের আড্ডায় ‘জনতা কার্ফু’ কতটা পালন হবে তা নিয়ে চর্চা ছিল। রবিবার সকাল ১০টাতেও যেন ঘুমিয়ে থাকল শহরের ব্যস্ততম মোড়গুলি। চা থেকে শুরু করে মুদি, আনাজের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। খোলেনি বাজারও। বন্ধ ছিল অনেক ওষুধের দোকানও। জাতীয়, রাজ্য সড়কগুলি ছিল প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তার মতোই নিস্তব্ধ। বেসরকারি বাস, ম্যাক্সি-ট্যাক্সি, অটোরিকশা, টোটো, ট্রাক রাস্তায় নামেনি। গুটিকয়েক রাষ্ট্রায়ত্ব পরিবহণ নিগমের বাস চলাচল করেছে। স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধেও এমন নিস্তব্ধতা দেখেনি বালুরঘাট।
গঙ্গারামপুর: চার দিক নিস্তব্ধ। সমস্ত দোকান, বাজার বন্ধ। রাস্তা জনশূন্য। রবিবার জনতা কার্ফুতে এমনই ব্যতিক্রমী ছবি ধরা পড়ল গঙ্গারামপুরে। শহরের বাসিন্দা অরুণাভ দাস বলেন, ‘‘গোটা শহর গৃহবন্দি। এক জনও রাস্তায় নেই। গঙ্গারামপুরে এমন ছবি আমি কোনও দিনও ভাবিনি। প্রত্যেক বাসিন্দাই সচেতন।’’ শুধু গঙ্গারামপুর নয়, বুনিয়াদপুর শহর ও কুশমণ্ডি, হরিরামপুরের ব্যস্ত এলাকাতেও এ দিন একই ছবি দেখা যায়।
উত্তর দিনাজপুর
রায়গঞ্জ: রবিবার সকাল থেকে রায়গঞ্জের সমস্ত দোকানপাট ও বাজার বন্ধ ছিল। দিনভর রাস্তাঘাট সুনসান ছিল। শহরের সুদর্শনপুর থেকে কসবা ও জেলখানা মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ ছিল। রায়গঞ্জের মোহনবাটী, গোশালা, দেবীনগর, চণ্ডীতলা, সুভাষগঞ্জ-সহ সমস্ত বাজারে কোনও দোকানপাট খোলেনি। রাস্তায় বেসরকারি বাস, ট্রেকার, অটো ও টোটোর দেখা মেলেনি। দুপুরে কয়েকটি টোটো চলতে দেখা গেলেও সেগুলিতে যাত্রী ছিল না। রায়গঞ্জের রমেন্দ্রপল্লি এলাকার বাসিন্দা প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক পার্থ মিত্রের বক্তব্য, ‘‘অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ডাকা অনেক বন্ধ দেখেছি। কিন্তু এ দিনের জনতা কার্ফু সে সবই ছাপিয়ে গিয়েছে।’’
ইসলামপুর: জাতীয় সড়কে নেই যানবাহনের শব্দ। রবিবারের এমনই সকাল ছিল ইসলামপুরে। শুধু সকালই নয়, বেলা গড়ালেও বদলায়নি তা। ইসলামপুরবাসীর দাবি, রাতে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে যানবাহন রাস্তায় না থাকায় দূষণ নেই। দূষণহীন পরিবেশ বাড়তি উপহার দিল ‘জনতা কার্ফু’ বলে দাবি সাধারণ মানুষের। ইসলামপুর শহরের মতোই ডালখোলা, করণদিঘি, চোপড়া গোয়ালপোখরেরও পরিস্থিতিও কার্যত একই। প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলিতেও রাস্তায় লোকজন ছিল না বললেই চলে। এ দিন অনেক গ্রাম্য এলাকায় হাট বার ছিল। তবে সে সবই বন্ধ ছিল। সারা দিনের নিস্তব্ধতা ভাঙে বিকেলের শঙ্খ, কাঁসর, ঘন্টার শব্দে।
কালিয়াগঞ্জ: রবিবার সকালে কালিয়াগঞ্জের মহেন্দ্রগঞ্জ বাজার ও তারা বাজার পুরোপুরি বন্ধ। শহরের বাজারগুলিতে গ্রাম থেকে আনাজ নিয়ে বিক্রিতে আসেন গ্রামের মানুষ। প্রতি দিন বাজারে ভিড় উপচে পড়ে। এ দিন মহেন্দ্রগঞ্জ দুধ বাজারে কয়েকজন বিক্রেতা দুধ নিয়ে আসলেও ক্রেতা না থাকায় বাড়ি ফিরে যান। হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি বাস চললেও ছিল না বেসরকারি বাস।