জলপাইগুড়ির আইপিটিএ হলে সাহিত্য সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে।
‘তুই নাকি চলে যাবি এখান থেকে?
হুঁ
আর আসবি না?
আসব তো! ছুটি হলেই আসব’।
‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসের শুরুর দিকে দুই চরিত্রের কথোপকথনই। প্রশ্ন করছেন ‘গোপা মাসি’ নামে এক চরিত্র। এবং যে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে ‘অনিমেষ’, কিশোর অনিমেষ। সে ছড়ে চলে যাচ্ছে স্বর্গছেঁড়া চা বাগান। যে বাগানে ‘চাপ-চাপ কুয়াশার দঙ্গল বাদশাহী মেজাজে গড়িয়ে’ যায় ‘সবুজ গালচের মতো বিছানো চা-গাছের উপর দিয়ে খুঁটিমারির জঙ্গলের দিকে’। সেই চা বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছিল অনিমেষ। স্বর্গছেঁড়া এবং অনিমেষ দুই চরিত্রের কাল্পনিক নাম। খুটিমারির জঙ্গল এবং দূরে আঙরাভাসা নদীকে রাখা সে চা বাগানের নাম গয়েরকাটা, অনিমেষ তবে কি কিশোর সমরেশ? গয়েরকাটা চা বাগানের বাড়ি ছেড়ে কিশোর বয়সে সমরেশ মজুমদার পড়তে এসেছিলেন জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে সেখান থেকে কলকাতায়। উত্তরাধিকারের অনিমেষও তাই। সোমবার তখন বিকেল সবে সন্ধেয় মিশছে, জলপাইগুড়ি শহর, জেলাস্কুলপাড়া, আঙরাভাসার তীরের খুঁটিমারি জঙ্গল, গয়েরকাটা চা বাগান জেনে যায় সমরেশ মজুমদার আর ফিরবেন না এ তল্লাটে।
ধূপগুড়ি পেরিয়ে গয়েরকাটা ঢোকার মুখেই গয়েরকাটা চা বাগান। বাগানে এখনও তাঁর স্মৃতি টাটকা। গয়েরকাটার বাসিন্দা ষাটের গোড়ায় পৌঁছনো কানাই চট্টোপাধ্যায় বললেন, “সুযোগ পেলেই উনি গয়েরকাটায় আসতেন। খুব টান ছিল। ফোনে বলেছিলেন, আবার এপ্রিলে আসবেন। কিন্তু আর আসবেন না!”
উত্তরাধিকার উপন্যাসে স্বর্গছেঁড়া থেকে জলপাইগুড়ি, তেলিপাড়া, কোচবিহারের মতো উত্তরে জনপদের কথা ছড়িয়ে রয়েছে সমরেশ মজুমদারের অসংখ্য উপন্যাস, গল্পে। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের কথা, তিস্তা পাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম সিগারেট জ্বালানোর কথাও সমরেশ মজুমদার কখনও সরাসরি, কখনও চরিত্র বদলে গল্প, উপন্যাসে লিখেছেন। কলকাতার ব্যক্তিজীবনেও উত্তরবঙ্গ বা জলপাইগুড়ি শুনলেই লেখকের অন্তরের সেই সুতোয় টান পড়ত। এক সকালে লেখার ব্যস্ততার মাঝে এক অচেনা সাংবাদিকের ফোন পেয়ে বিরক্ত গলায় ‘হ্যালো,’ বলার পরে, জলপাইগুড়ি থেকে ফোন গিয়েছে শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, “আরে জলপাইগুড়ি, বলো বলো।” বলেছিলেন, “শহরের আগেকার মতো গানের স্কুল আছে? জানো, আমাদের ছোটবেলায় অনেক গানের স্কুল ছিল।”
ছোটবেলার চা বাগান, বাড়ি ছেড়ে, কিশোরবেলার শহর ছেড়ে সমরেশ মজুমদার শেষ বার রওনা হলেন সোমবার বিকেলে।