মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — সংগৃহীত চিত্র।
মমতা জানিয়েছেন, নিজের কেন্দ্রে ইফতার করেন তিনি। তার পর ইদ পালন করে, পয়লা বৈশাখ করে আবার আসবেন উত্তরে। কারণ, পয়লা বৈশাখের আগের দিন তিনি কালীঘাটে মা কালীকে পুজো দেন। তার পরেই তিনি চলে আসবেন উত্তর।
মমতা বলেন, ‘‘অপেক্ষা কার জন্য? প্রধানমন্ত্রীর জন্য? টাকা তো তিনি দেবেন না। দেব আমরা। বলবে দাঙ্গা করো। খ্রিস্টানদের পুড়িয়ে দাও, যেমন মণিপুরে হয়েছে।’’ জলপাইগুড়িতে তিনি কী কী করে দিয়েছেন, তারও খতিয়ান দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘নতুন জেলা হয়েছে। নতুন স্টেডিয়াম। ডুয়ার্স-কন্যা হয়েছে। কটেজ হয়েছে। পাহাড়ে শান্তি। তরাই-ডুয়ার্সে শান্তি। জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে শান্তি। এরা চায় দাঙ্গা করতে।’’
মমতা জানালেন, সিএএ এবং এনআরসি-র সংযোগ রয়েছে। অসমে অনেক মানুষ ডিটেনশন শিবিরে। তাই দুটোর কোনওটাই করতে দেবেন না তিনি। ডিটেনশন ক্যাম্পও চালু করতে দেবেন না। বাইরে যাঁরা কাজ করতে যান, তাঁদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করানো হয়েছে। যাঁরা এ রাজ্যে কাজ করতে আসেন, তাঁরাও এই কার্ড দেখিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করাতে পারবেন।
লক্ষ্মীর ভান্ডার, রূপশ্রী, কন্যাশ্রীর কথা মনে করিয়ে দিলেন মমতা। আরও বললেন, ‘‘সিভিক পুলিশের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে, পঞ্চায়েতকে স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা দেওয়া হয়েছে। চা-বাগানের পাট্টা দেওয়া হয়েছে।’’ চা-বাগানের কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বাজেটেই ঘোষণা করেছেন বলে জানান মমতা। তিনি আরও জানান, এখন নির্বাচনী আচরণবিধি থাকার কারণে নতুন ঘোষণা সম্ভব নয়। ২০০ রাজবংশী স্কুলকে স্বীকৃতি, বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে ছুটি দিয়েছেন— মনে করালেন সে কথাও।
মমতা জানান, আবাসের টাকা রাজ্য সরকার দেবে। নির্বাচনী আচরণবিধি জারি রয়েছে। তার পরেই করা হবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ৭৫ শতাংশ টাকা, আর ওরা বলছে, ঘরে ঘরে পানীয় জল ওরা দিচ্ছে। ইডি যে টাকা নিয়েছিল, বলেছিল, গরিবদের মধ্যে বিতরণ করবে। কোথায় গেল সেই টাকা? ইডি যে টাকা নিয়েছে, তা বিজেপির কাছে গিয়েছে,’’— কটাক্ষ মমতার।
মমতা স্মরণ করালেন, মণিপুরে কী হয়েছে। কী ভাবে মহিলাদের নগ্ন করে ধর্ষণ করা হয়েছে! গুজরাতের নির্যাতিতার কথাও মনে করিয়েছেন তিনি। মমতার কথায়, ‘‘গুজরাতে নির্যাতিতার উপর অত্যাচার, কুস্তিগির সাক্ষীর উপর অত্যাচার দেখেননি? গুজরাতের দাঙ্গা, মহিলাদের নগ্ন করে হাঁটানো, দেখেননি? এই হচ্ছে বিজেপি। দলটাই ভাঁওতাবাজ।’’ তিনি জানান, কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, দেখাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে। চার-পাঁচ জন নিয়ে সমস্যা ছিল। প্যানেল করে পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। কিন্তু আবাসের টাকা আসেনি কেন? ১০০ দিনের কাজের টাকা আসেনি কেন? এ সব প্রশ্নও তুললেন মমতা।
মমতা বলেন, ‘‘সকলেই নাগরিক। আমরা এনআরসি করতে দেব না। কারও অধিকার কাড়তে দেব না। যখনই আবেদন করবেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার চলে যাবে। আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হবে, আপনি অনুপ্রবেশকারী। আমি তো আছি। আমি দিল্লি থেকে এসে রাজনীতি করি না। মাটির লোক।’’ মমতা বলেন, ‘‘এর পর শুনছি, দেশে অভিন্ন আচরণবিধি চালু হবে। হিন্দুদের, মুসলিমদের, রাজবংশী, জনজাতিদের বিয়ের পদ্ধতি আলাদা? কে কী ভাবে বিয়ে করবে, কোন শাড়ি পরবে? কী ভাবে পরবে? তা-ও ঠিক করে দেবে বিজেপি।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমরা কেন্দ্রের দয়া চাই না। যারা আবাসের টাকা দেয় না, কাজের টাকা দেয় না, তাদের টাকা নেব না। দয়া চাই না। প্রশাসন দেবে। কিন্তু অনুমোদন পেতে এত সময় লাগছে কেন?’’ তার পরেই মমতা বলেন, ‘‘সমস্যা হল, যাঁর বিয়ে, তিনি নিজেই পুরোহিত। নিজেই স্বামী, নিজেই স্ত্রী। নির্বাচন কেন্দ্রের। রাজ্যের নয়। নির্বাচন করছে বিজেপি পার্টি। কোথায় গণতন্ত্র? সারা পৃথিবী দেখে রাখুন, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ওয়ান নেশন, ওয়ান পার্টি চলতে পারে না। বিজেপি তা-ই করছে। বিজেপি আর নির্বাচন কমিশন এক হয়ে কাজ করছে। সে কারণেই নির্বাচনী আচরণবিধি মানে না বিজেপি। তার মধ্যে এনআরসি, ক্যা করছে। আপনি আবেদন করলেই আপনাকে ডিটেনশন শিবিরে রেখে দেবে, অসমের মতো।’’
মমতা বলেন, ‘‘হেলিকপ্টারে আসার সময় সংবাদমাধ্যমে দেখছিলাম, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলায় নির্বাচন কমিশন নজর রাখবে। আপনি বলার কে? কমিশনকেও কিনে নিয়েছেন? বলে দিয়েছেন, রোজ ওকে বদলি করো। ওর বাড়ি আয়কর দফতর পাঠাও। কানে কানে বলে দাও, বিজেপি করলেই সাদা! তৃণমূল করলেই কালো! দারুণ নাটক।’’ তিনি বলেন, ‘‘কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত কাউন্সিলরের বাড়িতে আয়কর দফতর গিয়েছিল। তাঁর বাচ্চা খেতে পারছে না। স্নান করতে পারছে না। আমি বললাম, ওরা খেল কী? বলছে, এত অর্ডার করছে। ওরা বলছে বিজেপি করো। তিনি বলেন, গলা কাটলেও করব না।’’ মমতার কথায়, ‘‘আমি বিজেপির মতো সন্ত্রাস করি না। কোথাও লেখা হচ্ছে ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভ। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের জানা থাকে না। ছোট জায়গা থাকে না। বড় জায়গার বিষয়ে থাকে। এটা নিয়ে বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। যাঁদের সব গিয়েছে, ঘর, হাঁড়ি, কড়া, কাপড়, কম্বল, সব কিছু, সব করে দেবে সরকার। নির্বাচনী আচরণবিধি চালু না থাকলে সব করে দিতাম।’’
মমতা বলেন, ‘‘শীতলখুচির ঘটনা মনে আছে আপনাদের? চার জন সংখ্যালঘু ভাই এবং এক জন রাজবংশী ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা করে বলল, বাংলাদেশি। তুমি জানলে কী করে? আগেই কেস লিখে দিচ্ছে। মেরে ফেলার অধিকার কে দিল? অনুপ্রবেশকারী হলে স্থানীয় পুলিশকে জানাও। গুলি করে লোক মারতে পারো না। এটা তোমার অধিকার নয়। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। তোমার নয়।’’
মমতা বলেন, ‘‘আত্মপ্রচারে ব্যস্ত মোদী। পাঁচ কেজির চালেও নিজের ছবি। তুমি দেশের প্রধানমন্ত্রী, সবাই তোমার নাম জানে। যদি এত আত্মবিশ্বাসী হও যে তোমরা জিতবে, তা হলে লোকের বাড়ি কেন তল্লাশি চালাচ্ছ? তোমার বিজেপি নেতারা এনআইএ-র সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে নথি আছে। তোমার বিজেপি নেতারা আয়কর দফতর, সিআইএসএফ-কে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ একটা সংবাদ দেখলাম। লজ্জার বিষয় যে, আর্মি হাসপাতালও বিজেপি অর্গানাইজারদের হাতে দিয়ে দিয়েছে। লজ্জা করে না? দেশে আর্মি কখনও রাজনীতি করেনি। বিএসএফ, সিআইএসএফ-ও করত না। আইটি-ও করত না।’’
মমতা জানান, তিনি সোমবার ভোরে চালসায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েও একই ছবি দেখেন। সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। এর পর তিনি বলেন, ‘‘অথচ প্রধানমন্ত্রী এসে বলেন, আমার নাম কেন নেই? অর্ধেক টাকা তোমার, অর্ধেক রাজ্যের, তোমার নাম কেন থাকবে? মানুষের নাম কেন থাকবে না!’’
কী কী পরিষেবা রাজ্য সরকার দিয়েছে ঝড়-বিধ্বস্ত উত্তরবঙ্গকে, জানালেন মমতা। তিনি জানান, প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছে। সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। প্রশাসনের কেউ ঘুমায়নি, চিকিৎসকেরা ঘুমাননি। তাই এতগুলি জীবন বাঁচানো গিয়েছে। সকলের চোখেমুখে আতঙ্ক কাজ করছিল। সকলের সঙ্গে কথা বলার পর আরও দু’-এক জায়গায় যান। ভোর ৪টের সময় চালসায় গিয়েছিলেন।
মঞ্চে উঠেই মমতা জানিয়ে দেন, ধুপগুড়িকে জেলা করা নিয়ে সব প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন নির্মল। এ বার তাই তাঁকে জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী করা হল। এর পরেই তিনি ঝড়বিধ্বস্ত উত্তরবঙ্গের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, ‘‘এর আগেও ছুটে এসেছি। যখন ভুটানের নদীর জল এখানে ঢুকে পড়েছিল। বেশ কয়েক জন ভাইবোন মারা গিয়েছিলেন। তখনও ছুটে এসেছিলাম। এ বার যখন শুনলাম, অপেক্ষা করিনি, ছুটে এসেছি। আগে গৌতমকে পাঠিয়েছিলাম। ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ক’টা পর্যন্ত বাগডোগরায় বিমান নামে? ও বলল, আপনিই তো করে দিয়েছিলেন, সাড়ে ১০টা। আমি ১১টায় পৌঁছলাম। গৌতমদের বলেছিলাম, যত ক্ষণ না যাব, তোমরা এলাকা ছাড়বে না। ওঁরা কথা শুনেছেন।’’
লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণার পর বৃহস্পতিবারই প্রথম রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কোচবিহারের রাসমেলা ময়দানে জনসভা তাঁর। কয়েক ঘণ্টা আগে কোচবিহারে সভা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কোচবিহারের মাথাভাঙার গুমানির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে সভা করেছেন তিনি। সেখানে নাম না করে আক্রমণ করেছেন বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে।