জলপাইগুড়ি ইউরোপিয়ান ক্লাব। ছবি: সন্দীপ পাল।
১৮৬৯ সালে জেলা পত্তন হওয়ার পরই রমরমিয়ে বেড়ে চলেছিল। জঙ্গল কেটে একের পর এক চা বাগান তৈরি হতে থাকে। জলপাইগুলি জেলা পত্তনের দশ বছরের মধ্যে কলকাতার সঙ্গে হলদিবাড়ি হয়ে প্রথম রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ইংরেজরা তো বটেই, অবিভক্ত দক্ষিণবঙ্গের বাসিন্দারা একে একে আসতে থাকেন জলপাইগুড়িতে। আসতে থাকেন পশ্চিমের রাজ্যগুলি থেকে অবাঙালি সম্প্রদায়।
স্থাপিত হয়েছিল আদালত এবং প্রশাসনিক কর্যালয়। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদালত ও সরাকরি কাজকর্ম বেড়ে চলে। তবে কোনও কিছুই পাকা ছিল না। তাদের প্রয়োজনে ইংরেজরা দু’টি পাকা স্থাপত্য তৈরি করেছিল। তার মধ্যে একটি জেলখানা, অন্যটি গির্জা। যার নাম সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অরেঞ্জেস চার্চ। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেরিটেজ স্থানগুলি নির্ধারণ কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্যের কাছে পাঠানো তালিকা অনুসারে শতাধিক বছরের পুরনো এই দু’টি স্থাপত্য জলপাইগুড়ির প্রথম পাকা দালান। যা এখনও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
জেল সূত্রে জানা যায়, সেখানে পুরনো প্রশাসনিক কার্যালয় এবং সংশোধনাগারের হাসপাতাল-সহ ১৩টা ওয়ার্ড এখনও আছে। ২০১০ সালের ভূমিকম্পে পুরনো ভবনের সামান্য ক্ষতি হয়। পরে সংস্কার করা হয়। এ বার এই ভূমিকম্পের মরসুমে জেলখানার কোনও ক্ষতিই হয়নি। জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের জেলার রাজীব রঞ্জন বলেন, “জলপাইগুড়ির এই সংশোধনাগারটি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে পরিণত হলেও পুরনো স্থাপত্যের কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। নতুন করে আটটি ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। ভূমিকম্প হলেও পুরনো ভবনের কোনও ক্ষতি হয়নি। যেহেতু পুরনো ভবন একইরকম আছে।’’ আর সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অরেঞ্জেস চার্চটি দেড় বিঘা জমির মাঝখানে অবস্থিত। গির্জা সূত্রে জানা যায়, এই গির্জাটি ১৮৬৮ সালে স্থাপিত হয়। পাকা ঘর তৈরি হয় ১৮৮৩ সালে। গির্জার বর্তমান যাজক রেভারেন্ড ডেভিড হাঁসদা বলেন, “এক সময় ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে এই গির্জাটি স্থাপন করেছিলেন। গির্জাটি একইরকম আছে। ভূমিকম্পে কোনও ক্ষতি হয়নি। ভবিষ্যতে আমরা গির্জাটিকে একইরকম রাখতে চেষ্টা করব। নতুন করে তৈরি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”
এর পরে আরও বেশ কয়েকটি স্থাপত্য গড়ে উঠেছে। য়ার মধ্যে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হয়েছে একটি মসজিদ। বর্তমানে জলপাইগুড়ি নবাববাড়ি আদালত সংলগ্ন এই মসজিদটি ১৮৮৫ সালে স্থাপিত হয়েছিল। তৈরি করেন মুন্সি রহিম বক্স। তিনি জলপাইগুড়ির তদানিন্তন সেটেলমেন্ট অফিসে কাজ করতেন। তিনি চা বাগান তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে গজলডোবায় তিনি একটি চা বাগান তৈরি করেন। শুধু তাই নয়, তিনি সেই সময় জলপাইগুড়ি শহরে বুধু বৈষ্ণবি নামে এক মহিলার কাছ থেকে ৩২ বিঘা জায়গা কিনে নেন। সেখানেই তিনি একটি পাকা মসজিদ তৈরি করেন। এই মসজিদ স্থাপনের বহু বছর পর ১৯২৭ সালে বৃদ্ধ বয়সে মসজিদের কাছে তিনি একটি পাকা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়িটিই বর্তমানে জলপাইগুড়ি জেলা আদালত। যা ‘নবাববাড়ি’ নামে খ্যাত। শতাধিক বছরের পুরনো এই মসজিদে ভূমিকম্প সামান্য প্রভাব ফেলেছিল। এই স্থাপত্যের ব্যবস্থাপক মহম্মদ একরাম আনসারি বলেন, “২০১২ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের কয়েকটি অংশে চিড় ধরেছিল। আমরা নিজেরা সেটা সংস্কার করে নিয়েছি। তবে এ বারের ভূমিকম্পে কোনও ক্ষতি হয়নি। মুন্সি সাহেবের করা মসজিদ একইরকম রেখে দেওয়া হবে।”
জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার, গির্জা এবং মসজিদটি ঠিকঠাক থাকলেও জলপাইগুড়ি ক্লাবের অবস্থা ততটাই খারাপ। ১৮৯৮ সালে ইংরেজদের উদ্যোগে জলপাইগুড়িতে ‘জলপাইগুড়ি ক্লাব’ গড়ে উঠেছিল। সংশোধনাগার এবং ধর্মীয় স্থান তৈরির পর ইংরেজদের নজর যায় আমোদপ্রমোদের দিকে। ১২ একর জায়গার ওপর ইংরেজরা এই দ্বিতল ভবনটি তৈরি করে। ক্লাবের বাইরে চারটি টেনিস কোর্ট ছিল এবং ভেতরে বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা আছে। একটি বারও আছে। আগেকার বলরুমটি এখন ফাঁকা। দোতলার থাকার জন্য চারটি ঘর অবহেলায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে। একমাত্র বার ছাড়া আর কোনও কিছুই ব্যবহার হয় না। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর গুরুত্ব হারাতে থাকে ক্লাবটি। ইংরেজ পরবর্তীকালে ভারতীয় চা ব্যবসায়ীদের হাতে ক্লাবের দায়িত্ব এসে যায়। ক্লাবটির আর্থিক অবস্থার আবনতি হতে থাকে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ। ক্লাবের সদস্য এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ইংরেজ আমলে ইংরেজ পরিচালিত চা কোম্পানিগুলি এই ক্লাবটিকে পরিচালনা করার জন্য আর্থিক সাহায্য দিত। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর সেই আর্থিক সাহয্য বন্ধ হয়ে যায়।
হেরিটেজ বিল্ডিং নির্ধারণ কমিটি তথ্য অনুযায়ী ১৯০০ সালের আগে জলপাইগুড়িতে পাকা বাড়ি বলতে ছিল জেলখানা, একটি গির্জা, একটি মসজিদ এবং একটি ক্লাব। বর্তমানে জেলখানা, গির্জা ও মসজিদটি পুরোপুরি ব্যবহার হলেও জলপাইগুড়ি ক্লাবটির ব্যবহার সে রকমভাবে হয় না। বাসিন্দাদের আশঙ্কা পুরনো এই স্থাপত্যটি হয়তো ব্যবহারের অভাবেই একদিন নষ্ট হয়ে যাবে। জলপাইগুড়ি ক্লাবের বর্তমান পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য সুব্রত পাল বলেন, “ভূমিকম্পে ক্লাবের কোনও ক্ষতি হয়নি। আমরা ক্লাবের ভবননি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ক্লাবের এই ঐতিহ্যশালী ভবনটির যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সে দিকে আমাদের নজর রয়েছে।’’
তবে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি পাকা স্থাপত্য ছাড়া আর কোনও ভবনই তৈরি হয়নি। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেরিটেজ কমিটির প্রাক্তন কোঅর্ডিনেটর আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “সেই সময় অফিস কাছারি যা কিছু হয়েছিল সবই ওপরে টিনের চাল দেওয়া ঘর। বেশিরভাগই বেড়ার ওপর চুন আর সুরকির প্লাস্টার করা।’’
(চলবে)