যানবাহনের ভিড়ে হারিয়েছে গরুর গাড়ি, অনটনে বৃদ্ধ কারিগর

সময় যত এগিয়েছে, পাকুয়াহাটের মতো গ্রামগঞ্জে ভুটভুটি চালুর পরে বাঁশ বা ধানের মতো পণ্য পরিবহনে ধীরে ধীরে কমেছে গরুর গাড়ির ব্যবহার।

Advertisement

জয়ন্ত সেন 

বামনগোলা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৪০
Share:

চিন্তা: হেমন্ত কর্মকার। নিজস্ব চিত্র

বছর দশেক আগের কথা। তখনও সন্ধ্যা হলেই পাকুয়াহাটের রাস্তা পেরিয়ে যেত গলায় ঘণ্টা বাঁদা গরুর পাল। কানে আসত গোরুর গাড়ির চাকার আওয়াজও। লণ্ঠন ঝুলিয়ে সে সব গরুর গাড়িতে বোঝাই ধান বা বাঁশ নিয়ে গান গাইতে গাইতে রাতভর চলতেন গাড়িয়ালরা। পরের দিন সকালে মালদহের কোনও হাট ছিল তাঁদের গন্তব্য।

Advertisement

সময় যত এগিয়েছে, পাকুয়াহাটের মতো গ্রামগঞ্জে ভুটভুটি চালুর পরে বাঁশ বা ধানের মতো পণ্য পরিবহনে ধীরে ধীরে কমেছে গরুর গাড়ির ব্যবহার। তাতে রুজির সুযোগ কমে গরুর গাড়ির চাকা তৈরির কারিগর পাকুয়াহাটের হেমন্ত কর্মকারের।

জীবন-যুদ্ধে টিকে থাকতে তিনি শুরু করেন কাঠ কেটে ঢাক, ঢোল বা মাদলের খোল তৈরির কাজ। সঙ্গে চলে দোতারা তৈরিও। কিন্তু এখন কমেছে ঢাক-ঢোলের চাহিদাও। সেই জায়গা নিয়েছে টিন বা স্টিলে তৈরি রেডিমেড ঢাক-ঢোল। তাতে ফের সঙ্কটে পড়েন বছর পঁয়ষট্টির হেমন্তের। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কী ভাবে দু’মুঠো ভাত জোগাবেন, তা ভেবে কুল পাচ্ছেন না তিনি। হেমন্তের আক্ষেপ, এই বয়সেও জোটেনি বার্ধক্য ভাতা। বাড়তি উপার্জনের জন্য কয়েক বছর ধরে একটি দলের সঙ্গে মনসার পালাগান করলেও লোকশিল্পীর মর্যাদা পাননি। ফলে কার্যত অসহায় অবস্থায়ন স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

Advertisement

বামনগোলা ব্লকের পাকুয়াহাট বাজারের কাছেই বাড়ি হেমন্তের। তিনি জানান, তাঁর তৈরি চাকার ভাল কদর ছিল। কিন্তু সত্তর দশকের শেষ দিকে যন্ত্রচালিত নানা যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় গরুর গাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করে। তবে সে সময়েও বামনগোলা বা পাশের হবিবপুর ব্লকে গরুর গাড়ি ছিল পণ্য পরিবহনের অন্যতম ভরসা।

তিনি জানান, সেই সময় একটি গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করলে মিলত প্রায় ১২ হাজার টাকা। তাতেই সংসার চলত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বামনগোলায় গরুর গাড়ির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। সেই জায়গা নিতে শুরু করে ভুটভুটি। ফলে বছর দশেক আগে পেশা বদলে হেমন্ত শুরু করেন কাঠ কেটে ঢাক, ঢোল, মাদলের চার বা খোল তৈরির কাজ। ব্যবসায়ীদের কাছে সেই ঢাকের খোল সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ঢোল বা মাদলের খোল বিক্রি হত তিন থেকে চার হাজার টাকায়। দোতারার কাঠামো বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়।

কিন্তু এখন সেই বাজারও মন্দা। বাড়ির দাওয়ায় বসে ঢাকের খোল বানানোর ফাঁকে হতাশার সুরে হেমন্ত বলেন, ‘‘এখন পুজোমণ্ডপে ঢাকের সিডি বাজে। স্টিল ও টিনের তৈরি সস্তার ঢাক বা ঢোলও বাজারে চলে এসেছে। ফলে কাঠের খোল দিয়ে তৈরি ঢাক, ঢোল, মাদলের কদরও কমেছে।’’

তিনি জানান, সংসার টানতে মাঝেমধ্যে এলাকারই একটি দলের সঙ্গে মনসার পালা গান করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, ভাওয়াইয়া, বাউল গান, গম্ভীরা গানের শিল্পীরা সরকারের তরফে লোকশিল্পীর মর্যাদা পেলেও মনসার পালা গান করা শিল্পীদের সেই তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়নি। ফলে লোকশিল্পীর ভাতাও মেলে না।

তাঁর আরও আক্ষেপ, ৬০ বছর পেরনোর পরে বার্ধক্য ভাতার জন্য পঞ্চায়েত অফিসে অনেক দরবার করেছেন। কাজ হয়নি। এখন আর অভিমানে কোনও সাহায্যের কথাও তিনি তা-ই বলেন না কাউকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement