মৃত্যুঞ্জয় বর্মণের দেহ সমাধি দেওয়া হল চাঁদগাঁও গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের রাধিকাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চাঁদগাঁওয়ে মৃত্যুঞ্জয় বর্মণের (৩৩) গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় পুলিশে অভিযোগ দায়ের হল শুক্রবার। এ দিন বিকেলে মৃত্যুঞ্জয়ের দাদা মৃণালকান্তি বর্মণ রায়গঞ্জ পুলিশ সুপারের অফিসে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ সুপার সানা আখতার অফিসে ছিলেন না। তার আগে, এ দিন মৃণালকান্তি রায়গঞ্জে বিজেপির জেলা কার্যালয়ে গিয়ে রায়গঞ্জের বিজেপি সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী ও বিজেপির আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন। বিজেপির জেলা কার্যালয়ে বসেই ওই অভিযোগপত্র লেখা হয়। মৃণালকান্তি কালিয়াগঞ্জ থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মৃত্যুঞ্জয়কে গুলি করে খুন করার অভিযোগ করেছেন। তাঁর দাবি, “বৃহস্পতিবার রাত ২টোয় তিনটি গাড়ি নিয়ে ২৫ জন পুলিশ কর্মী কালিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির বিজেপির সদস্য বিষ্ণু বর্মণকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল। বিষ্ণুকে না পেয়ে পুলিশ বিষ্ণুর বাবা বৃদ্ধ সবেন বর্মণকে গ্রেফতার করে। তার পরে পুলিশ বিষ্ণুর জামাই সাগরকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। মৃত্যুঞ্জয় পুলিশকে ওঁদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। তখনই মোয়াজ্জেম মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে গুলি করে ওকে খুন করেন।” এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার, এডিজি (উত্তরবঙ্গ) অজয় কুমারকে ফোন করা হলে তাঁরা ধরেননি। জবাব মেলেনি মেসেজের।
কালিয়াগঞ্জ থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকে মারধরের ঘটনার পিছনে হিন্দুত্ববাদী একাধিক সংগঠনের যোগ রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের দাবি। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগে পুলিশের তরফে তেমন দাবি করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, পরিকল্পিত ভাবে জেলার করণদিঘি, ইটাহার ও রায়গঞ্জ থেকে লোক নিয়ে থানায় হামলা চালানো হয়েছিল। রায়গঞ্জের মুখ্য বিচারবিভাগীয় আদালতের সরকারি আইনজীবী নীলাদ্রি সরকার জানিয়েছেন, পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেছে। তবে বিজেপির জেলা সভাপতি বাসুদেব সরকারের বক্তব্য, “থানায় হামলার পিছনে দলের সম্পর্ক নেই। তৃণমূল রাজবংশী, তফসিলি ও আদিবাসীদের মিছিলে লোক ঢুকিয়ে ওই কাণ্ড ঘটিয়ে বিজেপিকে ফাঁসিয়েছে।” পক্ষান্তরে, জলপাইগুড়িতে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি দুর্ভাগ্যজনক। যাঁরা রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া, তাঁরাই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করে বাংলায় অশান্তি করতে চাইছেন। এটাই বিজেপি।”
পুলিশের দাবি, কালিয়াগঞ্জ থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকর্মীদের মারধরের ঘটনায় বিষ্ণু জড়িত। ওই রাতে পুলিশ বিষ্ণুকে ধরতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল। অভিযোগ, তখন বিষ্ণুর পরিবারের লোকজন, আত্মীয় ও প্রতিবেশিরা পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি করেন। পুলিশকর্মীদের ঘেরাও এবং মারধর করা হয়। মোয়াজ্জেমের মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করা হয়। পুলিশ শূন্যে গুলি চালিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। কী ভাবে ওই যুবকের শরীরে গুলি লাগল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “পুলিশকে মারধর ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে বিষ্ণু ও তাঁর পরিবারের লোকজন-সহ অজ্ঞাত পরিচয়দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে।” মাথায় চোট নিয়ে রায়গঞ্জ মেডিক্যালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন মোয়াজ্জেমকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে পুলিশ। মেডিক্যালের সহকারি সুপার মৌমিতা আফরোজ শুক্রবার বলেন, “ওঁর শারীরিক পরিস্থিতি বর্তমানে স্থিতিশীল।” অন্য দিকে, কালিয়াগঞ্জের আইসি দীপাঞ্জন দাসকে শিলিগুড়ির রেল পুলিশের আইসি হিসাবে বদলি করা হয়। তাঁর জায়গায় শিলিগুড়ি রেল পুলিশ থেকেই কালিয়াগঞ্জের নতুন আইসি হলেন সুবলচন্দ্র ঘোষ।
গত ২১ এপ্রিল উত্তর দিনাজপুরে এক নাবালিকার দেহ উদ্ধার হয়। তাকে গণধর্ষণ করে খুনে সব অভিযুক্তকে ফাঁসির দাবিতে মঙ্গলবার কালিয়াগঞ্জ শহরে প্রতিবাদ মিছিল করে থানায় স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন ‘রাজবংশী, তফসিলি ও আদিবাসী সংগঠনের সমন্বয় কমিটি’র হাজার হাজার মানুষ। অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা থানায় ঢুকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকে মারধর করেন। বুধবার রাতে বিরাট পুলিশ বাহিনী বিষ্ণুকে ধরতে তাঁর বাড়িতে যায়। এ দিন ভোরে বাড়ির পাশে মৃত্যুঞ্জয়ের দেহ সমাধি দেওয়া হয়। কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁর স্ত্রী গৌরী বলেন, “স্বামীকে যে পুলিশকর্মীরা খুন করল, তাদের সকলের ফাঁসি চাই।”
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও ১৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অ নিয়ে এখনও গ্রেফতার হলেন ৫২ জন। তাঁদের মধ্যে রায়গঞ্জের কানাইপুরের নারায়ণ বর্মণ শুক্রবার আদালতে দাবি করেন, “আমি বিজেপি কর্মী। তাই পুলিশ বিনা দোষে আমাকে ধরেছে।” যদিও জেলা তৃণমূল সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়ালের পাল্টা দাবি, ‘‘বিজেপি ভাঁওতাবাজি করে রেহাই পাবে না।’’