অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য যান নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষও। নিজস্ব চিত্র
বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ময়নাগুড়ির দোমহনি বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। এখানেই লাইনচ্যুত হয়েছে পটনা থেকে গুয়াহাটিগামী ১৫৬৩৩ আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস।
শীতকালে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে এখানে। বৃহস্পতিবারও তেমনই ঘটেছিল। সেই সময় আচমকাই লাইনচ্যুত হয়ে যায় পটনা থেকে গুয়াহাটিগামী আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। দুর্ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক পর দোমোহনিতে পা রাখতেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। চার দিকে শোরগোল, চিৎকার। কোথাও বা কান্নার শব্দ। রেললাইনের ধারে দুর্ঘটনাস্থলের বাতাস এখন ভারী। চোখ চলে গেল দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ট্রেনটির বগিগুলির দিকে। একটির ঘাড়ে উঠে পড়েছে আর একটি বগি। যেন খেলনা ট্রেন।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেক ক্ষণ। অন্যান্য দিন এত ক্ষণে ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় দোমহনি। কিন্তু আজকের এই দৃশ্য দেখে কে বলবে এখন রাত আটটা বাজে! চারপাশে আলো জ্বলছে। জেনারেটর চলছে। ছুটোছুটি করছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। চিকিৎসক, নার্স, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, পুলিশ, রাজ্য সরকারের কর্তা, রেলের আধিকারিক, মন্ত্রী, প্রশাসনিক কর্তা— ঠান্ডা বাতাস আর ঘন হয়ে নামতে থাকা কুয়াশায় সব মিলিয়ে উদ্ধারকাজের এক বিপুল আয়োজন। সকলের লক্ষ্য, প্রাণ বাঁচাতে হবে।
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন যাত্রীরা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এখন গ্যাস কাটার দিয়ে একের পর এক বগি কাটা চলছে। কামরার কোন কোণে পাওয়া যাবে প্রাণের সন্ধান, তার খোঁজ চালাচ্ছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। যাত্রীদের সকলেই যে গুরুতর জখম এমন নয়। অনেকের আঘাত সামান্য। তাঁদের চিকিৎসা হচ্ছে দুর্ঘটনাস্থলেই। একলহমায় আঘাত বুঝে নিয়ে কাউকে পাঠানো হচ্ছে হাসপাতালে। কারও বা হচ্ছে প্রাথমিক চিকিৎসা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে আলোর বৃত্তের প্রান্তের দিকে ওই ট্রেনেরই কয়েক জন যাত্রীকে দেখা গেল বসে থাকতে। সঙ্গে মালপত্রও রয়েছে কিছু। ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার অভিঘাত তাঁদের কামরায় পৌঁছেছে কিছুটা লঘু হয়ে। অবস্থানগত কারণে আরও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের চোখে মুখে আতঙ্কের একটা প্রহর কাটানোর ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ঘোর কাটেনি বিপর্যয়ের। প্রশাসন ময়নাগুড়ি বিএড কলেজে তাঁদের রাত কাটানোর থাকার ব্যবস্থা করেছে।
বিপর্যয়ের মুখে যাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র
আরও একটা ব্যাপার নজরে এল। দুর্ঘটনার পর থেকেই উদ্ধার কাজে হাত লাগিয়ে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও স্থানীয়দের উৎসাহ কমেনি। প্রাথমিক ভাবে আহতদের অনেককে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কাছাকাছি অবস্থিত ময়নাগুড়ি হাসপাতালে। কাউকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে অথবা কাউকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়। এশিয়ান-২ হাইওয়ে দিয়েই ছোটার কথা ওই অ্যাম্বুল্যান্স গুলির। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, ওই রাস্তা এখন যানজটপ্রবণ। অথচ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হল সময়ের।
রাতের অন্ধকারে জারি উদ্ধারকাজ। নিজস্ব চিত্র
বিপর্যয়ের এই মুহূর্তে সময় বাঁচানোই যে আহতদের সুস্থ করে তোলার প্রাথমিক শর্ত তা জানেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। এশিয়ান-২ হাইওয়ের যান সামলাতে সাধারণত হিমশিম খেতে হয় পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশ কর্মীদের। বৃহস্পতিবার প্রয়োজনের এই মুহূর্তে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন স্থানীয়রা। নিজেরাই কাঁধে তুলে নিলেন যান নিয়ন্ত্রণের ভার। অন্যান্য গাড়িগুলিকে সরিয়ে দিলেন আশপাশের রাস্তায়। মূল রাস্তা খালি করে দিলেন অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য। সবুজ সঙ্কেত পেয়ে আহত যাত্রীদের নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সও ছুটল হাসপাতালের দিকে। সময় বাঁচানোর সেই লড়াইয়ে শামিল অ্যাম্বুল্যান্সচালকরাও।