প্রতীকী ছবি।
সংখ্যায় ওঁরা হাতে গোনা ক’জন। কিন্তু সে ক’জনই যেন এখন আলিপুরদুয়ার শহরের ভবঘুরেদের অন্যতম ভরসা। তা সেই ভবঘুরে রাস্তায় পড়ে থাকুন বা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে— নিয়ম করে বাড়িতে রান্না করা খাবার তাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসছেন ওঁরা। এক-দু’দিন নয়, শুধু করোনা-লকডাউনেও নয়, গত প্রায় তিন বছর ধরে ঝড়, জল, বৃষ্টি উপেক্ষা করে, নিয়মিত।
আলিপুরদুয়ার শহরের বছর চল্লিশের নির্মল সরকারের হাত ধরেই এই পথ চলাটা শুরু। পেশায় শুকনো ফুলের ব্যবসায়ী নির্মল ২০১৭ সালে আলিপুরদুয়ার শহরে এসে শান্তিনগরের সাহাপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। এর মধ্যেই একদিন পাড়ার এক যুবককে ট্রেনে তুলে দিতে নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই প্ল্যাটফর্মের পাশে বসে খিদের জ্বালায় এক বয়স্ক ভবঘুরে মহিলাকে কাঁদতে দেখেন।
নির্মলের কথায়, “খুব খারাপ লেগেছিল। বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি। সব কথা শুনে তিনি আমাকে উৎসাহ দেন ভবঘুরেদের জন্য কিছু করতে।” তার পর মাঝেমধ্যে রাত হলেই ব্যাগে করে শুকনো খাবার নিয়ে স্টেশনে স্টেশনে গিয়ে ভবঘুরেদের খাওয়াতে শুরু করেন তিনি। যে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন, তার মালিক বিশ্বজিত সাহা বলেন, “পুজোর সময় দেখতাম, রাত হলেই ব্যাগে খাবার ও জামা-কাপড় নিয়ে নির্মল কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেস করে সবটা জানলাম।”
বিশ্বজিত বিষয়টা তাঁর বন্ধুদের জানান। সব শুনে সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই কাজে। সেই দলে পুরকর্মী, ব্যবসায়ী ও গ্যারেজকর্মী, সবাই ছিলেন। গড়ে ওঠে ‘আমরা ক’জন’ দল। দলের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে ভবঘুরেদের খাবার তৈরির জন্য রান্নার সরঞ্জাম কেনেন। তার পর প্রতি সোমবার নির্মলের বাড়িতে রান্না করে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে রেল স্টেশন ও রাস্তার পাশে থাকা ভবঘুরেদের খাবার বিলি শুরু হয়।
করোনায় ওঁদের কাজ আরও বেড়ছে। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ১৮ অগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন দুবেলা করে অভুক্তদের খাবারের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। নির্মলের স্ত্রী অনিতা বলেন, “এই কাজে আমিও গর্ব বোধ করি। তাই বাড়িতে যতটা সম্ভব রান্নাতে সাহায্য করি।” নির্মল বলেন, “রোজ আমার বাড়িতে যা রান্না হচ্ছে, সেটাই শহরের রাস্তায় থাকা কয়েক জন ভবঘুরেদের দিয়ে আসি। পরে ট্রেন চালু হলে সংখ্যাটা বাড়বে আবার।”
এই অসময়ে যাঁরা ক্ষুধার্তের মুখে খাবার জোগান দিচ্ছেন, তাঁদের কুর্নিশ জানাচ্ছে সারা বিশ্ব। নির্মল বললেন, ‘‘আমরা যে চালিয়ে যেতে পারছি, এটাই আমাদের কাছে সব থেকে বড় পাওনা।’’