বালুরঘাট কলেজের সংগ্রহশালায় রক্ষিত প্রত্নসামগ্রী। নিজস্ব চিত্র।
বালুরঘাট কলেজ মিউজিয়াম থেকে কষ্ঠিপাথরের একটি মূল্যবান মূর্তি চুরি হয়েছে। কিন্তু সেই মূর্তি ও মূর্তি চোরের কোনও হদিশ নেই। সকলেই খুব দুশ্চিন্তায়। কিন্তু পুলিশমহল এই মূর্তি চুরির কোনও কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। মূর্তি চুরির রহস্য ভেদ করতে অবশেষে কাকাবাবুর শরণাপন্ন হয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কাকাবাবুও সন্তুকে নিয়ে বালুরঘাটে এলেন। টান টান উত্তেজনা ও নানা রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে কাকাবাবু ও সন্তু মিউজিয়ামের মূর্তি চুরির রহস্য ভেদ করলেন।
১৯৮১ সালে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বালুরঘাট থেকে ফিরে গিয়ে পুজো সংখ্যা আনন্দমেলায় ওই গল্প লেখেন। তারও আগে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯৭৬ সালের ২১ ডিসেম্বর মিউজিয়ামের ভিজিটর্স বুক-এ লিখে যান, ‘বালুরঘাট কলেজের সংগ্রহশালা দেখে অশেষ তৃপ্তি পাওয়া গেল। অতীতের যে দর্শন এখানে ধরা হয়েছে, তাতে নিজেদের মুখচ্ছবির কিছুটা আদল কি মেলে। জানি না। কিন্তু পরম্পরায় একটি মূল্যবান সূত্র মেলে ঠিকই। সেই সূত্রটিকে আরও ভালো করে ধরবার জন্য আবার আসব বালুরঘাটে।’
প্রয়াত পুরাতত্ত্ববিদ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের দেবলা মিত্র, প্রাক্তন রাজ্যপাল বিডি পান্ডে, ঢাকা মিউজিয়ামের প্রাক্তন ডিরেক্টর এনামুল হক দেখে গিয়েছেন বালুরঘাট কলেজ মিউজিয়াম। স্কটল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক ডেভিড ম্যাক্কাচিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ভেরনন টুপার, নিউজিল্যান্ডের রবীন লিচ, লন্ডন মিউজিয়ামের ভ্লাদিমির জোয়ালফ—কে নন। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত প্রত্নবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বালুরঘাট কলেজ সংগ্রহশালাটি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। মিউজিয়ামের ভিজিটর্স বইয়ের পাতা উল্টোলে চোখে পড়বে আর কত বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসালিপি।
১৯৬৭ সালে ইউজিসি-র আর্থিক সহায়তায় এবং বালুরঘাট কলেজের তৎকালীন সংস্কৃতের শিক্ষক অচিন্ত্যকৃষ্ণ গোস্বামীর উদ্যোগে নিজস্ব একটি একতলা ভবনে সংগ্রহশালার ভবনটি তৈরি হয়। তাতে রাখা হয় জেলার গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে তিল তিল করে সংগৃহীত পুরাকীর্তির নিদর্শন, যা আজও দুই দিনাজপুর জেলার প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পরে কলেজে মিউজিওলজি বিষয়ে পাঠ্যক্রম চালুর জন্য ইউজিসির তরফে সাড়া মেলে। বর্তমানে মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বিবেক দাস বলেন, ২০০৭ সালে সর্বেক্ষণের দফতর থেকে সংরক্ষিত গ্যালারি এবং প্রত্নসামগ্রী সুরক্ষিত করে মিউজিয়ামটি গড়ে তোলার জন্য ৪৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রথম দফায় পাঠানো ওই বিভাগের ১৫ লক্ষ টাকা এবং পরে জেলাপরিষদ থেকে কিছু অর্থসাহায্য পেয়ে দোতলা মিউজিয়াম ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্তু অতীতের ওই প্রত্ন সম্ভারকে সিন্দুকের ভিতরে গুপ্ত দলিল-দস্তাবেজ লুকিয়ে রাখার মতোই ওই দোতলা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আড়াল করে দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রজন্ম তো বটেই, খোদ কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও মিউজিয়াম দেখার সুযোগ নেই বলে অভিযোগ।
কিন্তু এই অবস্থা কেন?
কলেজ সূত্রেই খবর, সর্বেক্ষণ থেকে বরাদ্দ ৪৩ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার পরে বাকি ২৮ লক্ষ টাকা দু’বছর বাদেই কলেজকে দেওয়া হলেও তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই টাকা পাননি বলে অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে কলেজের তরফে অনেক চিঠিচাপাটির পর শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে ওই ২৮ লক্ষ টাকা কোথায় গেল তা নিয়ে রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশন তদন্তে নামে।
মিউজিয়ামের ভারপ্রাপ্ত ইতিহাসের শিক্ষক বিবেকবাবু বলেন, ‘‘তৎকালীন কলেজ অধ্যক্ষের ‘সই জাল’ করে ওই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে। কিন্তু কে বা কারা নগদে ব্যাঙ্ক থেকে কী করে টাকা তুলল ? হদিশ করে উঠতে পারেনি ওই তদন্তকারী সংস্থা।’’
এরপর অ্যান্টি করাপশন বিভাগ থেকেও বালুরঘাট কলেজে এসে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হয়। তারাও নথি পরীক্ষা করে চলে যান। কিন্তু শেষপর্যন্ত তদন্তে কী হল, তার কিছু জানা নেই বলে বিবেকবাবু জানিয়েছেন। এর ফলে কলেজে স্নাতক স্তরে তিন বছরের মিউজিওলজি বিষয় নিয়ে পঠনপাঠনের উদ্যোগও আর এগোয়নি। অথচ বালুরঘাট কলেজে ইতিহাস বিভাগে প্রথমবর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষে অনার্সের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৬০ জন। পাসকোর্সে অন্তত প্রায় ৪ হাজার ছাত্রছাত্রী এবং এমএ-তে ১১০ জন পড়ুয়া রয়েছেন। হাতের কাছে এমন একটি নিজস্ব সংগ্রহশালা পেয়ে অধিকাংশ ইতিহাসের পড়ুয়া মিউজিওলজি বিষয় নিয়ে পড়তে চান।
কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি অজয় সাহা বলেন, ‘‘টাকার হদিশ পেতে কলেজের তরফে এজি বেঙ্গল দফতরেরও একাধিকবার চিঠি পাঠিয়ে তদন্ত শেষ করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি।’’ মিউজিয়াম তৈরির কাজও থমকে। মিউজিওলজি পাঠ্যক্রমের উদ্যোগও বিশ বাঁও জলে।
সমস্যার বিষয়টি জেনে কলেজের একাংশ পড়ুয়ার কথায়, সুনীলবাবু বেঁচে থাকলে কাকাবাবু ফিরে এসে ২৮ লক্ষ টাকার রহস্যভেদেও একবার নেমে পড়তেন কাকাবাবু ও সন্তু।