নয়াপাড়ার বাড়িতে রিয়াজের মা রুজিনা বিবি । মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।
অভাবের কারণে ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছিলেন বাবা। পরিবর্তে, বেঙ্গালুরুতে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসেবে দুই ভাইকে তিন মাস কাজ করে দিতে হবে, এই চুক্তি ছিল ঠিকাদারের সঙ্গে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই চুক্তি মতো কাজ করতে বেঙ্গালুরু গিয়েছিল দুই ভাই। কাজ শেষ করে ছোট ভাই রজব আলিকে (১৫) নিয়ে বাড়ি ফিরছিল রিয়াজ আফ্রিতি (১৭)। ওড়িশায় দুর্ঘটনায় পড়া যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরায় ছিল ওরা। দুর্ঘটনায় তাদের কামরা উল্টে যায়। রিয়াজের বাঁ হাত কাটা পড়েছে। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার বিভাগে বর্তমানে রিয়াজ চিকিৎসাধীন। সোমবার রেল দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রিয়াজের কৃত্রিম হাত দেওয়ার জন্য এসএসকেএম কর্তৃপক্ষকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন বলে খবর। কলকাতা থেকে রিয়াজের বাবা রুহুল আলম বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ছেলেকে নকল হাত লাগিয়ে দেবেন বলেছেন।’’ রিয়াজকে চাকরি দেওয়ার কথাও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বলেজানান রুহুল।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হরিরামপুরের সৈয়দপুর অঞ্চলের উত্তর দিনাজপুর লাগোয়া নয়াপাড়ার বাসিন্দা রিয়াজ। রিয়াজের বাবা রুহুল আলম দিনমজুরি করেন। মঙ্গলবার দুপুরে রিয়াজের মা রুজিনা বিবি বলেন, ‘‘৩৫ হাজার টাকা নিয়ে দুই ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম ভিন্ রাজ্যে। এখানে কাজ নেই। রোজগারের জন্য ছেলেদের বাইরে পাঠাতে হয়।’’ ছেলে যে প্রাণে বেঁচেছে, তাতে কিছুটা স্বস্তি মায়ের। চোখের জল মুছে রুজিনা বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যদি ওকে একটা চাকরি দেন, তা হলে ছেলেটাবেঁচে যাবে।’’
রিয়াজের ছোট ভাই রজব এখনও দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতির কথা ভুলতে পারছে না। বলে, ‘‘কামরা উল্টে যাওয়ায় দাদা দরজা দিয়ে ছিটকে বাইরে চলে গিয়েছিল। খুঁজে দেখি, দাদার হাতটা চার জায়গায় ভেঙে ঝুলে রয়েছে।’’ দাদার বাঁ হাতের কনুইয়ের কিছুটা উপর থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছে বলে জানাল রজব।
তার মা রুজিনা জানান, চণ্ডীপুর এইচবি হাই স্কুলে পড়াশোনা করত রিয়াজ। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে রজবকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে পাড়ি দেয় সে। বেঙ্গালুরুতেই অনলাইনে মাধ্যমিকের রেজ়াল্ট জানতে পারে সে। এর পরে, বাড়িতে ফোন করে সে জানায়, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে বাড়ি ফিরে আসছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রুজিনাকে ফোন করে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা জানায় রজব। এর পরে, গাড়ি ভাড়া করে কটক পৌঁছন তাদের বাবা রুহুল। অভিযোগ, সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছিল না। তাই রুহুল ওই গাড়িতেই রবিবার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে আসেন রিয়াজকে। সেখানে তার হাত বাদ দেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্লাস্টিক সার্জারি করা হবে রিয়াজের। তার পরে কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা হবে।
চোখের সামনে এত মৃত্যু দেখে আতঙ্কিত রিয়াজের ছোট ভাই রজব। নবম শ্রেণির পড়ুয়া রজব জানাল, আর কখনও ট্রেনে চাপবে না বলে ভেবে রেখেছে সে। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা কত দিন টিকবে তা সে জানে না। কারণ, নয়াগ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই পরিযায়ী শ্রমিক।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের নজরুল ইসলাম বললেন, ‘‘গ্রামের ১,৪০০ ভোটারের মধ্যে ৮০০ বাসিন্দাই বাইরে কাজ করেন। গ্রামের উচ্চ শিক্ষার হারও তলানিতে। কলেজ পাশ বাসিন্দা দুই-এক জন রয়েছেন। বাকিরা সবাই মাধ্যমিকের পরে, স্কুলছুট। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো রিয়াজ চাকরি পেলে, ও-ই হবে এই গ্রামের প্রথম চাকরিজীবী।’’ রিয়াজের স্কুল চণ্ডীপুর এইচবি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জিৎ সরকার বলেন, ‘‘রিয়াজ পরীক্ষা দিয়েই বাইরে চলে গিয়েছিল। খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।’’