তালা বন্ধই স্কুলে। বাবাকে সাহায্য করতে মূর্তি গড়ছে ধনজিৎ। নিজস্ব চিত্র
তপ্ত দুপুর। মাথার উপরে চড়া রোদ। ছোট্ট টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরের এক কোণে বসে আপন মনে প্রতিমার মুখ তৈরি করছে ধনজিৎ। স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই একটু স্থির হয়ে গেল সে। বলল, “কত দিন স্কুলে যাইনি! খুব যেতে ইচ্ছে করে।” কোচবিহারের ঘুঘুমারি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ধনজিৎ বর্মণ।
স্কুলের কথা বলতেই ধনজিতের মতোই একাদশ শ্রেণির মনোজ সরকার বলে ওঠে বিড়বিড় করে— কত কাছে, কিন্তু কত দূরে! ইটাহারের রেজিনা খাতুনের পড়াও এক বছর ধরে বন্ধ। আর তৃতীয় শ্রেণির রেমিকা মার্ড? তার তো পড়ার বই ব্যাগবন্দি হয়ে তোলা রয়েছে বাঁশের আগায়।
অথচ ধনজিতের স্কুল বাড়ি থেকে মোটে দু’কিলোমিটার দূরে। কিন্তু শেষ কবে সে স্কুলে গিয়েছিল, মনেও করতে পারে না। একটু চেষ্টা করে বলে, “এক বছর তো হবেই।” এই পুরো সময়টায় বাবার কাছে মূর্তি গড়ার কাজ শিখেছে সে। বাবা নন্দ বর্মণ বলেন, ‘‘পড়াশোনা নেই, এমনি বসে আছে। পরিবারের কাজটা তাই শিখিয়ে দিলাম।’’ এখন লক্ষ্মী-সরস্বতী থেকে মনসা, বেশ কিছু মূর্তি গড়তে পারে ধনজিৎ। তবে পড়া পুরোপুরি ছেড়ে দেয়নি সে। সকাল-সন্ধ্যে ক্লাসের বই খুলে বসে। কিন্তু স্কুল যে বন্ধ, শিক্ষক পাবে কোথায়?
ন’বছরের রেমিকা তো বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠে যেতে শুরু করেছে, ধান কাটতে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে চকসাদুল্লা এলাকার বাসিন্দা তারা। এই বয়সেই সে ধান কাটতে পারে? বাবা-মা বলেন, ‘‘পারে কোই? কিন্তু বাড়িতে থেকেই বা কী করবে? তাই মাঠে নিয়ে যাই।’’
বংশীহারি ব্লকের বদলপুর গ্রামের বাসিন্দা মনোজ সরকার সতেরো ছুঁয়েছে। চ্যাংড়া পিছলা উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তারও লেখাপড়া বন্ধ বছরখানেক। মনোজের কথায়, ‘‘বাবার রোজগার নেই। চুক্তিতে ধান কাটি। সংসারে কিছুটা সাহায্য হয়।’’ স্কুল খুললে? ‘‘দেখা যাবে,’’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে সে।
উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে সুরুন-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কেওটাল এলাকার বাসিন্দা রেজিনা। নবম শ্রেণির ছাত্রী সে। রায়গঞ্জের গৌরী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত এলাকা হাতিয়া। সেখানকার হাইস্কুলে পড়ে সে। রেজিনা বলে, “এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ। আমার বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। টাকার অভাবে মোবাইল ফোন কিনতে পারিনি। তাই গত বছর অনলাইন ক্লাসও করতে পারিনি। . এক বছর ধরে পড়াশোনা বলতে গেলে বন্ধই।”
কোচবিহারের একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “গ্রামের দিকে গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। অনেকের কাছে মোবাইলও নেই। তাই স্কুল বন্ধ হতেই তাদের পড়াশোনার পাট বলতে গেলে চুকে গিয়েছে। প্রথমে কিছু দিন তা-ও যেটুকু যোগ ছিল, টানা বন্ধে সে সবই কেটে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শহরের দিকে এই ছবি ততটা স্পষ্ট নয়। তবে যত প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়া যায়, ততই পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। অনেকেই পড়া ছেড়ে বাবা-মায়ের কাজে হাত লাগাতে শুরু করেছে।’’ এই প্রবণতা চলতে থাকলে স্কুলছুটও বাড়বে বলে জানিয়েছেন মালদহের এক স্কুলের শিক্ষক।
তত দিনে স্কুলঘরের আঁধার ঘিরে ফেলবে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতকেও।
(প্রতিবেদন: নমিতেশ ঘোষ, নীহার বিশ্বাস, অনুপরতন মোহান্ত, গৌর আচার্য, পার্থ চক্রবর্তী,
অভিজিৎ সাহা)