Accident

ভোরের মরণধাক্কা

তিনটি জায়গা ঘুরে প্রতিবেদন লিখছেন কৌশিক চৌধুরী, বাপি মজুমদার ও অরিন্দম সাহা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৫:১২
Share:

বাঁ দিকে, দুর্ঘটনার পরে এমনই অবস্থা হয়েছে গাড়িটির। হাহাকার: মাঝখানে, শোকার্ত দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার। ডান দিকে উপরে, শোকগ্রস্ত মনোজের  মা। ভালুকাবাজারের বাড়িতে। ডান দিকে নীচে, তাপসের শোকস্তব্ধ পরিবার। তুফানগঞ্জের বাড়িতে।—নিজস্ব চিত্র।

এক জন বাড়িতে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘এ মাসের শেষেই বাড়ি ফিরছি।’’ আর এক জন কষ্ট করে মানুষ। এখন বড় ছেলে ডাক্তারি পড়ছে। পরিবার, পাড়ার সকলকে নিয়ে খুশি তিনি। তৃতীয় জন, যাঁকে নিয়ে ওঁরা বালুরঘাট থেকে যাচ্ছিলেন কলকাতায়, সেই দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের অন্যতম বড় সশস্ত্র বাহিনী, শিলিগুড়ি কমিশনারেটের ফুলবাড়ির দ্বাদশ ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব গত মাসেই নিয়েছিলেন। শুক্রবার ভোরে হুগলির দাদপুরে এক পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন তিন জনই, দেবশ্রী, তাঁর দুই সহকর্মী তুফানগঞ্জের তাপস বর্মণ ও হরিশ্চন্দ্রপুরের মনোজ সাহা। তিনটি জায়গা ঘুরে প্রতিবেদন লিখছেন কৌশিক চৌধুরী, বাপি মজুমদার ও অরিন্দম সাহা।

Advertisement

মায়ের মতো ভাল

Advertisement

শিলিগুড়ি

উত্তরবঙ্গের অন্যতম বড় সশস্ত্র বাহিনী, শিলিগুড়ি কমিশনারেটের ফুলবাড়ির দ্বাদশ ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব গত মাসেই নিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই আর দশজন সিও বা কমান্ডান্টের মতো শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার নন, নিজেদের পরিবারের মতো বাহিনীকে তৈরি করে ফেলছিলেন দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়। পুলিশ পরিবারের আবাসনের পরিকাঠামো সংস্কার থেকে করোনা মোকাবিলায় এই ক’দিনে সকলের পাশে থেকেছেন সবসময়। রাতবিরেত, সাতসকালে প্রয়োজন হলেই ছুটে এসেছেন ব্যাটালিয়নে।

শুক্রবার সকালে ব্যাটালিয়নে দেবশ্রীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর পৌঁছনোর পর থেকেই শোকের ছায়া। সকলের একটাই কথা, কেন যে ম্যাডাম ভোররাতে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতে গেলেন! তাঁর সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, ছোটবড় সবাইকে নিয়েই কাজ করতে পছন্দ করতেন দেবশ্রীদেবী। তাই কেউ কেউ এ দিন বলে ফেলেন, ‘‘আমরা মাতৃহারা হলাম।’’ তাঁর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মানবপাচার দমনে, বলছেন তাঁর সহকর্মীরাই। জানাচ্ছেন, রায়গঞ্জের কসবা ব্যাটালিয়ন থেকে এখানে এসেই তিনি এই কাজে সকলকে সজাগ করেছিলেন। ব্যাটালিয়নের ৭৬ জন এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের খোঁজ নিতেন নিত্য। এক গ্রুপ-ডি কর্মী মারা যান। তাঁর পরিবার যাতে দ্রুত সরকারি সাহায্য পায়, তার জন্য ঝড়ের গতিতে কাজ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন রাজ্য সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরবঙ্গের আইজি চেলিং সিমিক লেপচাও।

ফেরা হল না

তুফানগঞ্জ

এ মাসেই বাড়ি আসার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ফোন করে সে কথা জানিয়েওছিলেন। শুক্রবার সকালে সেই পুলিশ কর্মী তাপস বর্মণের (৩০) মৃত্যুর খবর এসে পৌছনোর পর তাঁর তুফানগঞ্জের বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। দুর্ঘটনায় তরতাজা একজন যুবকের মৃত্যুর খবরে শোকের আবহ গোটা এলাকাতেও। তাঁর আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, ভাই বেঁচে নেই, ভাবতেই পারছি না।”

কোচবিহারের তুফানগঞ্জের অন্দরান ফুলবাড়িতে তাপস বর্মণের বাড়ি। বাড়িতে বাবা, মা, ভাই ছাড়াও স্ত্রী ও তিন বছরের কন্যা সন্তান রয়েছে। চাকরির সুবাদে তাপস বাইরে থাকলেও নিয়মিত ফোন করে পরিবারের খোঁজ নিতেন। ছুটি পেলে বাড়িতেও আসতেন। বৃহস্পতিবার রাতেও বাড়িতে মোবাইলে ফোন করেন তিনি। মেয়ের ব্যাপারেও খোঁজ নেন। ভাই চন্দন বলেন, “সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে বাড়ি ফিরবে, বলছিল। তার পর যে সকাল হতে না হতে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি।’’

বছর ছয়েক আগে পুলিশে চাকরি পান তাপস। তারপর থেকে তিনিই সংসারের হাল ধরেন। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকে বাবা ললিত বর্মণ, মা কৌশল্যা দেবী, স্ত্রী পাপিয়া সকলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাঝেমাঝে মূর্চ্ছা যাচ্ছেন মা, স্ত্রী দুজনেই। তাঁদের এক আত্মীয় বলেন, “ওঁরা কেউই কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’’ হতবাক ছোট্ট ইশিকাও। পড়শিরা বলেন, ‘‘ওদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না!’’

ছিলেন অভাব জয়ী

হরিশ্চন্দ্রপুর

নিজে কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন। তাই প্রতিবেশী, অভাবী আত্মীয়, সবার পাশে দাঁড়াতেন। ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াবে। গত বছর বড় ছেলে ডাক্তারিতে সুযোগও পেয়েছেন। ছোট ছেলে পড়ে দশম শ্রেণিতে। সেই সাজানো সংসার ফেলে চলে গেলেন ভালুকাবাজারের মনোজ সাহা (৪৯)।

মনোজরা দু’ভাই, পাঁচ বোন। গরিব পরিবার। তবে ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী মনোজ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় ক্রমে সংসারের হাল ফেরে। পাঁচ বোনের বিয়েও দেন। বন্ধু, আত্মীয়রাই জানাচ্ছেন, সংসারের কথা ভেবে বাড়তি মাইনে পাওয়া যাবে বলে সিয়াচেনের মতো এলাকায় কষ্ট করে দীর্ঘদিন থেকেছেন। বাড়ি ফিরলেই তাঁর কাজ ছিল অভাবী যুবকদের দৌড়, শরীরচর্চায় উৎসাহী করা। তাঁর প্রেরণায় এলাকার অন্তত ১৫ জন যুবক সেনায় যোগ দিয়েছেন। ছোট ভাই পঙ্কজও অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী। অভাবী আত্মীয়দের নিয়মিত আর্থিক সাহায্যও করতেন।

২০০৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর ওই বছরেই পুলিশে যোগ দেন মনোজ। দুই ছেলের পড়াশুনার কথা ভেবে সম্প্রতি মালদহে থাকতেন। বাড়িতে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মা সুশীলা সাহা কেঁদেই চলেছেন। মায়ের কাছে রয়েছেন বোন নীতু। তিনি বলেন, ‘‘দাদার জন্য গোটা সংসারটা টিঁকে ছিল। এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে ভাবতে পারছি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement