শালতোড়ার গ্রামে সরস্বতী পুজো করছেন রমণী কিস্কু ও শিউলি বাউড়ি (সামনের সারিতে)। —নিজস্ব চিত্র।
একে মেয়ে, তায় অব্রাহ্মণ!
পৌরোহিত্যের মতো পুরুষপ্রধান পেশাকে দিনযাপনের মাধ্যম করে তোলাটা প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ বটেই। তবে তার থেকেও বড় পরীক্ষা ছিল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া সাম্রাজ্যে জায়গা করে নেওয়া।
সেটাই শুরু করেছেন এ রাজ্যের মুষ্টিমেয় কিছু নারী। সংস্কৃত মন্ত্র, পুজোপদ্ধতি, হোম-যজ্ঞের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা আসছেন পুরোহিতের পেশায়। বাধা আসছে, পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে গ্রহণযোগ্যতার পরিসরও। এঁরা কেউ অন্ত্যজ শ্রেণির, কেউ বা জনজাতি সম্প্রদায়ের।
বাঁকুড়ার শালতোড়ের রমণী কিস্কু, বাঁসুলী সরেন বা শিউলি বাউড়িরা নির্দ্বিধায় মুখোপাধ্যায় পরিবারের লক্ষ্মীপুজোয় পুরোহিত হচ্ছেন। আবার গ্রামের স্কুলে সরস্বতী পুজোর দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। নারীর অধিকার আন্দোলনের নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে নিঃশব্দে, ধর্মীয় গোঁড়ামির ঔদ্ধত্য উবে যাচ্ছে বাষ্পের মতো।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে এই মহিলারা দাবি করেছেন, বৈদিক বর্ণাশ্রমের ভিত্তি কুল বা পরিবার নয়, বরং গুণ এবং কর্ম। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের নির্ধারক মাপকাঠি হল উপযুক্ত শিক্ষা। যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। ফলে গার্গী-মৈত্রেয়ী-অপালা-লোপামুদ্রাদের উত্তরসূরি হয়ে ওঠার পূর্ণ অধিকার রয়েছে রমণী-শিউলি-বাঁসুলীদের। পৈতে নেই বা ঋতুকালীন সময়ে অপবিত্র—এই সব টিপ্পনীও শুনতে হয়েছে। কিন্তু ওঁরা দমেননি।
শালতোড়ার তেঁতুলাগড়া গ্রামের মেয়ে রমণী যখন পুরোহিতের কাজ শিখবেন বললেন, বাবা ভগবান কিস্কু একটু থমকেছিলেন প্রথমে। পরামর্শ করেছিলেন গ্রামপ্রধানের সঙ্গে। কার পর? রমণী বলছেন, ‘‘বুড়া বলল মারাং বুরুও দেবতা আর দুগ্গা-সরস্বতীও দেবতা। পূজা সবই সমান। ভাল কাজ। শিখলে দোষ নেই।’’ কোথায় শিখলেন? বছরখানেক হল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মেয়েদের পৌরোহিত্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে একটি সংস্থা। তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছেন রমণীরা। গ্রামের সরস্বতীপুজোয় এ বছর রমণীই পুরোহিত ছিলেন। সঙ্গী গোগড়া গ্রামের শিউলি বাউড়ি।
দরিদ্র চাষি স্বপন বাউড়ির মেয়ে শিউলি ছোটবেলা থেকেই একরোখা। বংশে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাশ। এক গাল হেসে বলেন, ‘‘জাত তো মানুষের তৈরি করা। আমি যখন পুরুত হব ঠিক করেছি, তখন হব। সরস্বতী পুজো করছি শুনে কয়েক জন বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের বাকিরা বললেন, মেয়ে যখন করতে চায়, করুক। ঠাকুর তো সবার।’’
শালতোড়ার বাঁসুলী সরেন এ বছর উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছেন। গত অক্টোবর থেকেই পৌরোহিত্যের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ বছর গ্রামে দুর্গাপুজো করতে বদ্ধপরিকর বাঁসুলী। এক মুখ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘‘ঠাকুর কি বলেছে অব্রাহ্মণ মেয়েরা পুজো করবে না? যজ্ঞ করবে না? দেখতে হবে আমি কতটা শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে, সুষ্ঠু ভাবে মন থেকে পুজোটা করছি। সেটাই তো আসল।’’
এ রাজ্যে অব্রাহ্মণ মহিলাদের পুরোহিত হওয়ার ইতিহাস অবশ্য পুরনো। ১৯৬৭ সালে গৌরী চৌধুরী ও গৌতম ধর্মপালের বিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীমৎ অনির্বাণ। তাঁর সহযোগী ছিলেন অব্রাহ্মণ নারায়ণী দেবী। বিয়ের পর গৌরী ধর্মপাল বৈদিক বিবাহ নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। আশির দশক থেকে এই কলকাতায় বেশ কিছু বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর পৌরোহিত্যে, বৈদিক মতে। তিনিই প্রথম বিবাহ পদ্ধতি থেকে কন্যা সম্প্রদান বাদ দেন।
গৌরীও অব্রাহ্মণই ছিলেন। সেই সময় এই লড়াইয়ে তিনি ছিলেন কার্যত একা, ব্যতিক্রমী। বহু দিন পর্যন্ত তাঁর কোনও উত্তরসূরি তৈরি হয়নি। ফলে প্রচেষ্টা দানা বাঁধতে পারেনি। গত এক বছর ধরে কিন্তু জগদ্দল নড়ছে। একসঙ্গে কলকাতা ও জেলার এক ঝাঁক অব্রাহ্মণ
মহিলা যোগ দিয়েছেন পৌরোহিত্যের কাজে। তাঁদের মধ্যে গৌরীর মেয়ে রোহিণী যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন মৌ দাশগুপ্ত, মৌমিতা দাস, দক্ষিণ দিনাজপুরের সুলতা মণ্ডল, কলকাতার সোনালী হালদার, মালদহের মীরা হালদারেরা। কর্মবাদে ভরসা রেখেই কর্মভেদ রুখছেন তাঁরা। পুরোহিতের কাজ শেখানো সংস্থাটির তরফে দেবদত্ত মাজি বলেন, ‘‘উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত এবং পুরুষপ্রধান কিছু কাজে তথাকথিত মেয়েদের প্রবেশ খুব জরুরি। এঁদের অর্জিত প্রত্যয় পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হবে বলেই আমাদের আশা।’’