দামি উপহারে দানের রক্তের সুরক্ষা বেহাল

শহর কলকাতা হোক কিংবা মফস্‌সল বা গ্রামাঞ্চল, ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির’ কথাটি বরাবরই কৌতুকী প্রশ্ন তুলে দেয়। প্রশ্নটা এই: ‘দান’ই যদি হবে, সেটা তো স্বেচ্ছাতেই। তা হলে আর ব্যানার-বিজ্ঞাপনে ‘স্বেচ্ছা’ শব্দটি উল্লেখ করার বাহুল্য কেন?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪২
Share:

শহর কলকাতা হোক কিংবা মফস্‌সল বা গ্রামাঞ্চল, ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির’ কথাটি বরাবরই কৌতুকী প্রশ্ন তুলে দেয়। প্রশ্নটা এই: ‘দান’ই যদি হবে, সেটা তো স্বেচ্ছাতেই। তা হলে আর ব্যানার-বিজ্ঞাপনে ‘স্বেচ্ছা’ শব্দটি উল্লেখ করার বাহুল্য কেন?

Advertisement

প্রসঙ্গটা ফিরে আসছে বিধি ভেঙে যৌন পল্লিতে রক্তদান শিবির আয়োজনের সূত্রে। ফিরে আসছে দামি উপহারের টোপ গিলে দানের বদলে রক্ত ‘বিক্রি’র হিড়িক লেগে যাওয়ায়। বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, অধিকাংশ রক্তদান শিবিরেই এখন দামি উপহার দেওয়ার চল হয়েছে। ফলে বিষয়টা আর ‘দান’-এর পর্যায়ে থাকছেই না। সেটা কার্যত বিনিময় বা বিক্রির নামান্তর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রবণতার বিপদের দিকটিও তুলে ধরছেন তাঁরা। এতে এখনই রাশ টানতে না-পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নির্দেশিকা অনুযায়ী রক্তদান শিবিরে উপহার দেওয়া নিষিদ্ধ। একই নির্দেশিকা রয়েছে ন্যাশনাল এড্স কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)-এরও। তবু উপহারের বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ চলছে অবাধে। সোনাগাছির রক্তদান শিবিরেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রাজ্যের রক্ত-সুরক্ষার ছবিতে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। মঙ্গলবার কিছু ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তা স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

গত শনিবার সোনাগাছির শিবিরে উপহার হিসেবে বড় ব্যাগ ও ননস্টিক ফ্রাইং প্যান দেওয়া হয়েছিল। দানের মহতী অভিপ্রায় ছাপিয়ে লোভ কী ভাবে বড় হয়ে হয়ে উঠছে, ‘দাতাদের’ বয়ানই তার প্রমাণ। ওই শিবিরের এক রক্তদাতা জানান, কী উপহার দেওয়া হবে, সেটা দিন কয়েক আগে থেকেই প্রচার করা হচ্ছিল। দু’টিই খুব দরকারি জিনিস। দামও বেশি। ‘‘তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের এক জন মাস দেড়েক আগে অন্য শিবিরে রক্ত দিয়েছিল। সে জানতে চেয়েছিল, আবার রক্ত দিতে পারবে কি না। ক্লাবের ছেলেরা জানান, অসুবিধা নেই। সকলেই রক্ত দিতে পারবে,’’ বললেন ওই দাতা।

এই প্রবণতাটাই মারাত্মক বলে মনে করছেন ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা। কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রধান এ দিন স্বাস্থ্য ভবনকে জানান, সম্প্রতি তাঁদের কর্মীরা উত্তর কলকাতার একটি ক্লাবের রক্তদান শিবিরে গিয়ে দেখেন, দাতাদের মোবাইল ফোন দেওয়া হচ্ছে। মানুষ তাই রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন দিয়েছেন। উপহারের বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল। কিন্তু ক্লাবকর্তাদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তাঁদের হার মানতে হয়েছিল।

রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের এক কর্তা জানান, পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক বিভিন্ন ক্লাবকে ‘টার্গেট’ (লক্ষ্যমাত্রা) দিয়ে রাখে। নির্দিষ্ট মাত্রায় (ইউনিট) রক্ত জোগাড় করতে পারলে ক্লাবের উন্নয়নে টাকা বা রঙিন টিভি দেওয়া হয়।

রক্তদান আন্দোলন নিয়ে কর্মরত একটি সংগঠনের তরফে দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘এমন অনেককে জানি, যাঁরা ফি-রবিবার কোথায় রক্তদান শিবির হচ্ছে, কারা কী উপহার দিচ্ছে, তার খবর খুঁজে বেড়ান। তার পরে তাঁরা ঠিক করেন, কোথায় যাবেন।’’ এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান না-রেখেই অনেকে লাগাতার রক্ত দিয়ে যেতে থাকেন। অনেকে নিজেদের অসুখ গোপন করেও রক্ত দেন।

‘‘পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। আমরা বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পাচ্ছি। রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতি (স্যাক্স)-কে আমরা এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারও করেছি বহু বার। প্রয়োজনে আবার করব,’’ দিল্লি থেকে বললেন ন্যাকো-র এক কর্তা।

স্যাক্স ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

স্যাক্স-কর্তারা জানান, তাঁদের কাছে অভিযোগ এলে তাঁরা তা খতিয়েও দেখেন। গত কয়েক মাসে কিছু বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক রক্তদান শিবিরে উপহার দিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটিতে আবার দাতার রক্তের গ্রুপ ভুল লেখা ছিল। ওই সব ব্লাড ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।

সোনাগাছির মতো যৌন পল্লিতে রক্তদান শিবিরের বিরুদ্ধে এ দিন প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি পাঠিয়েছে। বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে চিঠি পাঠিয়ে দাবি জানান, অবিলম্বে ওই শিবির থেকে সংগৃহীত রক্ত নষ্ট করে ফেলা হোক।

ব্যতিক্রমও আছে। সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির নথি জানাচ্ছে, গত মাসেই উত্তর কলকাতার একটি ক্লাব আয়োজিত শিবিরে ৫৫০ জন রক্ত দেন। সেখানে কোনও উপহারের ব্যবস্থা ছিল না। মধ্য কলকাতার একটি সংগঠন শিবিবের ব্যানারেই লিখে দিয়েছিল, উপহার দেওয়া হবে না। তবু সেখানে ৩২৫ জন রক্ত দিয়েছেন। এমন নজির কম নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement