সিঙ্গুরের মঞ্চে তিনি অনিচ্ছুক চাষি, নম্বর ৩২০।
দশ বছর আগে সিঙ্গুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিডিও অফিস অভিযানের দিন তিনিও ছিলেন। পুলিশ তাঁর চুলের মুঠি ধরে কালো ভ্যানে তুলে নেয়। পিঠে পড়েছিল লাঠির ঘা। চার দিন জেলেও থাকতে হয়েছিল মালতী দে-কে। বাড়ি ফিরেছিলেন যখন, তখনও ছিল পুলিশের লাঠির কালশিটে দাগ। তিনি পণ করেছিলেন, মরে গেলেও দেবেন না তাঁর দেড় বিঘে জমি। সেই থেকে হয়ে গিয়েছিলেন অনিচ্ছুক চাষি।
বুধবার ক্ষতিপূরণের চেক পেয়েছেন মালতীদেবী। তার পরই ভেজা চোখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আর কী হবে চাষ করে! ওখানে আর চাষ হবে না। আমাদের জমিতে তো টাটার শেড। চাষ করে লাভ নেই। শিল্পই হোক সিঙ্গুরে।’’
সে কী! এমন কথা কেন? চাষ করবেন বলেই তো দশ বছর অনিচ্ছুকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। তা হলে, আজ কেন শিল্প চাইছেন? মালতীদেবীর চোখ আর বাঁধ মানে না— ‘‘বাবা, লাঠি খেয়েছি। জেল খেটেছি। ধার করে সংসার চালিয়েছি। ছেলের হাতে কাজ নেই। কারখানাটা হলে ছেলে দুটো কিছু কাজ তো অন্তত জোটাতে পারত!’’
পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছেন মালতী দেবীর মেজ ছেলে কেষ্ট দে। তিনি বলেন, ‘‘চাষ করব বলেই তো জেদ ধরে ছিলাম। কিন্তু কী হল! জমি যাওয়ার পরে গাড়ি কারখানার গ্যারেজে কাজ করি। কখনও কাজ পাই, কখনও পাই না। ন্যানো হলে অন্তত কারখানায় তো কাজ পেতে পারতাম।’’
সুযোগ যে হাতছা়ড়া হয়েছে, তা বুঝে গিয়েছেন বাজেমেলিয়ার শ্রীকান্ত দাস। তাঁর জমিতেও এখন দাঁড়িয়ে আছে টাটার শেড। ছেলে অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে বেকার। শ্রীকান্তের আক্ষেপ, ‘‘জানেন, ছেলের কাছে মুখঝামটা খেয়ে চেক নিতে এসেছি। আজ ও বলল— যাও, আন্দোলন করেছিলে। এ বার চেক নিয়ে এসো। আমি তোমার সঙ্গে যাব না। টাটারা থাকলে কাজ পেতাম।’’ শ্রীকান্ত তাই বলছেন, ‘‘বুঝলেন, দশ বছর চাষ করিনি। শিল্পই হোক। এক ভুজিয়াওয়ালার কারখানায় কাজ করে সংসার চালাই। চাষে আর ভবিষ্যৎ নেই।’’
কিন্তু ভবিষ্যৎ কীসে?
তুষার শিট, বামাপদ সাঁতরার মতো অনিচ্ছুক কৃষকেরা বলছেন, পরচা হাতে পেলেই ভবিষ্যৎ আমাদের। খাসের ভেড়ি, বাজেমেলিয়ায় এঁদের জমি গিয়েছে। কোথাও কারখানা মাথা তুলেছে, কোথাও হয়েছে জমির উপর
দিয়ে রাস্তা। এঁরা আজ ক্ষতিপূরণ পেলেন দশ বছর পরে। ২০১২ সালের মে মাস থেকে পাচ্ছেন মাসে দু’হাজার টাকা আর ১৬ কেজি চাল। যার নাম মুখ্যমন্ত্রীর ‘সিঙ্গুর প্যাকেজ’। ক্ষতিপূরণ আর প্যাকেজের পরে এ বার তাঁদের হাতে আসছে পরচা। এই মওকা পেয়ে তাঁরা বলছেন, ‘‘চাষ তো আর হবে না। যে কারখানা করবে, সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলুক। দামে পোষালে জমি বেচে দেব।’’
অনিচ্ছুকদের মনে এখন জমি বেচারই বাসনা। কারণ, সরকার চাইলেও এ জমি চাষযোগ্য হবে বলে মানেন না নবকুমার ধাড়া, দিলীপ সামন্ত, তারারানি দাসেরা। তাঁদের বক্তব্য, দশ বছরে বদলে গিয়েছে জীবন। কর্মঠ ছেলেরা অনেকেই কাজের খোঁজে চলে গিয়েছেন বাইরে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সংসার বেড়েছে। ফলে, চাষ করে আর হাল ফিরবে না। তাই, এখন যদি কেউ শিল্প করতে আসে, তাদের মোটা টাকায় জমি বেচাই সহজ পথ। এতে ক্ষতিপূরণের টাকাও এল, প্যাকেজও পাওয়া গেল। আবার সেই জমি বেচে ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করা যাবে। এতে আবার মত নেই রূপা দাস, অশোক ঘোষ, বিজন দাস, প্রদ্যুৎ দাসদের। এঁদের কারও জমিই টাটার শেডের মধ্যে পড়েনি। সিঙ্গুরের মঞ্চে তাঁদের অনেকেই এ দিন এসেছিলেন সরকারের দেওয়া চাষি-নম্বর আর পার্টির দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি গলায় ঝুলিয়ে। মমতার হাত থেকে প্রথম পরচা নেওয়া কৃষক অশোক ঘোষের বক্তব্য, ‘‘জমি দিতে চাইনি। জোর করে কেড়ে নিয়েছিল। ক্ষতিপূরণ নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ মুখ্যমন্ত্রী ওই জমির পরচা ফেরত দিলেন। ওখানে চাষই করব। শিল্প হলে মানুষ খেতে পাবে না।’’ এ দিনই মমতার হাত থেকে ক্ষতিপূরণের চেক পাওয়া আর এক চাষি বিজন দাসের বক্তব্য, ‘‘পাহাড় ভেঙে চাষ হয়, আর এখানে হবে না!’’
এই কথা শুনে আশপাশের অনিচ্ছুকদের অনেকেরই খোঁচা, ‘‘কোনও দিনই চাষ হবে না। যাঁরা বলছেন চাষ হবে, তাঁদের আসলে তিন শতক জমি গিয়েছিল। এত দিন ক্ষতিপূরণ না নিলেও এই আমলে তিনটে করে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং তাঁরা তো এখন এ কথা বলবেনই।’’ এ সব কথা শুনে ফুঁসছেন বিজন। বলছেন, ‘‘যোগ্যতা থাকলে তবে তো চাকরি পাবে। পেটে বিদ্যে না থাকলে কি মাস্টার হওয়া যায়!’’
পেছনে বসে মালতী দেবীর মেজ ছেলে কেষ্ট বিড়বিড় করে বলেন, ‘‘দাদা এ বিরাট ক্যাচাল। কোনও দিন মিটবে না।’’