লন্ডনে লগ্নি-সফর, কিন্তু মমতার সরকারি দলে নেই শিল্পপতিরাই

২০১৪-য় সিঙ্গাপুর। ২০১৫-র গোড়ায় ঢাকা। এ বার লন্ডন ব্রিজ পেরনোর পালা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২৫ জনের ‘সরকারি’ প্রতিনিধিদল নিয়ে আগামী জুলাইয়ে লন্ডন ও গ্লাসগো সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি কলকাতাকে লন্ডন করে তোলার পরিকল্পনার সুষ্ঠু রূপায়ণও যার অন্যতম লক্ষ্য।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। ব্রিটেনে শিল্প টানার সফরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের বাছাই তালিকায় রয়েছেন এই দুই আস্থাভাজন। —ফাইল চিত্র।

২০১৪-য় সিঙ্গাপুর। ২০১৫-র গোড়ায় ঢাকা। এ বার লন্ডন ব্রিজ পেরনোর পালা।

Advertisement

সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২৫ জনের ‘সরকারি’ প্রতিনিধিদল নিয়ে আগামী জুলাইয়ে লন্ডন ও গ্লাসগো সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি কলকাতাকে লন্ডন করে তোলার পরিকল্পনার সুষ্ঠু রূপায়ণও যার অন্যতম লক্ষ্য।

কিন্তু সরকারি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ‘লগ্নি-সফর’-এর সঙ্গী-তালিকায় এখন পর্যন্ত এক জনও শিল্পপতি নেই। বরং ১৫ জন মন্ত্রী-আমলা-জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি তাতে ঠাঁই পেয়েছে জনা দশেক শিল্পী-গায়ক-অভিনেতার নাম। যদিও সরকারি সূত্রের দাবি, কয়েক জন শিল্পপতিকে সামিল করার চেষ্টা চলছে। তেমন কেউ রাজি হলে তাঁদের যে নিজের খরচে যেতে হবে, প্রশাসনের তরফে তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

২৭ জুলাই থেকে প্রস্তাবিত চার দিনের ব্রিটেন সফরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী হবেন রাজ্যের অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। এ ছাড়া মমতার প্রতিনিধি-তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। উল্লেখ্য, কলকাতা পুরভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পিছনে শোভনের ‘অবদানের’ তারিফ সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে একাধিক বার শোনা গিয়েছে। পাশাপাশি গিরিশ পার্কে পুলিশকে গুলি করার ঘটনার পরেও ভোটের দিন সুরজিৎবাবুর নেতৃত্বাধীন কলকাতা পুলিশকেই মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ খেতাব।

এ হেন প্রেক্ষাপটে সফরসঙ্গীর ‘বাছাই তালিকা’য় শোভন-সুরজিৎ জুটির নির্বাচনের নেপথ্যে পুরভোটের ফলাফলের ছায়া দেখছে প্রশাসনের একাংশ। যার পাল্টা হিসেবে সরকারি কর্তার যুক্তি, ‘‘কলকাতাকে যদি লন্ডন বানাতে হয়, তা হলে তো মেয়র বা পুলিশ কমিশনারকে বাদ দিয়ে কিছু হতে পারে না! তাই ওঁরাও যাচ্ছেন।’’

প্রাথমিক পর্বে বিবেচনায় থেকেও অনেকে অবশ্য পরে বাদ পড়েছেন। প্রশাসনের অন্দরের খবর: গত ৩০ এপ্রিল, বাম-বিজেপির ডাকা ধর্মঘটের দিন নবান্নে বসে মুখ্যমন্ত্রী যে সরকারি প্রতিনিধি তালিকা চূড়ান্ত করেছেন, তাতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বা যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নাম নেই। এমনকী, পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বাদ!

প্রসঙ্গত, ২০১৪-র অগস্টে মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরে মন্ত্রী বলতে ছিলেন শুধু অমিতবাবু। গত ফ্রেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন ফিরহাদ ও ব্রাত্যবাবু। ঘাটালের সাংসদ তথা অভিনেতা দেব অবশ্য সিঙ্গাপুর ও ঢাকার মতো লন্ডনেও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী হতে চলেছেন। মমতার অনুমোদিত তালিকা এ বার বিদেশ মন্ত্রক ও ব্রিটিশ সরকারকে পাঠানো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রের বক্তব্য, সফরের এখনও তিন মাস বাকি। তাই তালিকায় ছোটখাটো অদলবদল অসম্ভব নয়।

গত ৮-৯ জানুয়ারি সল্টলেক স্টেডিয়ামে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর আয়োজন করেছিল রাজ্য শিল্প দফতর। সেই শিল্প সম্মেলনে ইউকে-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের প্রধান প্যাট্রিশিয়া হিউইট এসেছিলেন। তিনিই মুখ্যমন্ত্রীকে ব্রিটেনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ক’দিন বাদে ব্রিটিশ এমপি-দের একটি দল কলকাতায় এসে মমতার সঙ্গে দেখা করে। মাস দুয়েক আগে ব্রিটিশ সরকারের তরফে সরকারি আমন্ত্রণ নবান্নে এলে মুখ্যমন্ত্রী সম্মতি দেন।

এবং সফর সংগঠনের যাবতীয় দায়িত্ব তখনই তিনি সঁপে দিয়েছেন অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাঁধে। শিল্প দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ব্রিটেন সফরের মূল উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গে বিলেতের লগ্নি টেনে আনা। একই উদ্দেশ্যে গত অগস্টে তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিল্প সম্মেলন ও সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেই সম্মেলনে ১৩টি বাণিজ্যিক ইচ্ছাপত্রও সই হয়েছিল। যদিও শেষমেশ তার ক’টা বাস্তবায়িত হয়েছে, শিল্প-কর্তারা তার হদিস দিতে পারেননি।

তবে এ বার বিনিয়োগ আকর্ষণের মতো কলকাতাকে লন্ডনের ধাঁচে সাজানোর পরিকল্পনার অগ্রগতিও মুখ্যমন্ত্রীর ব্রিটেন সফরের অন্যতম লক্ষ্য বলে আধিকারিকদের দাবি। তাঁরা জানিয়েছেন, মূলত মহানগরের পুলিশ-প্রশাসন, স্বাস্থ্য, নাগরিক পরিষেবা, সৌন্দর্যায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিলেতের অভিজ্ঞতা মুখ্যমন্ত্রী কাজে লাগাতে আগ্রহী। ‘‘সফর-সঙ্গী বাছাইয়ের সময়ে এই ব্যাপারটাও মাথায় রাখা হয়েছে।’’— বলছেন নবান্নের এক কর্তা। কী রকম?

সরকারি সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত তৈরি তালিকা অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যাবেন তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু, ডেরেক ও’ব্রায়েন, দীপক অধিকারী (দেব), মন্ত্রী অমিত মিত্র ও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। অফিসার-আমলাদের মধ্যে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎবাবু ছাড়া যাচ্ছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে, শিল্প-সচিব এস কিশোর, শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কৃষ্ণ গুপ্ত, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প-সচিব রাজীব সিংহ, মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম সান্যাল, নিরাপত্তা-অধিকর্তা বীরেন্দ্র ও মুখ্যমন্ত্রীর এক সিকিওরিটি অফিসার। যে দশ জন শিল্পীকে মুখ্যমন্ত্রী লন্ডনে নিয়ে যাবেন, তাঁদের তালিকায় রয়েছেন বিক্রম ঘোষ, রাশিদ খান, ঊষা উত্থুপ, ইন্দ্রনীল সেন, পুলক শর্মা, ভি সুরেশ প্রমুখের নাম। তার মানে শিল্প সফরে কোনও শিল্পপতি থাকছেন না!

‘‘থাকছেন না, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।’’— দাবি শিল্পোন্নয়ন নিগমের এক কর্তার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শিল্পপতিদেরও সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। নিগমের এমডি ও এক অফিসার চলতি মাসের শেষে লন্ডনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের খুঁটিনাটি ঠিক করে আসবেন। এ-ও দেখবেন, বিলেতের কোন কোন সংস্থা এখানে বিনিয়োগে প্রাথমিক ভাবে আগ্রহী। তার ভিত্তিতে এখানকার শিল্পপতিদের সফরসঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হবে।’’ তা হলে শিল্পপতিদের নাম সরকারি প্রতিনিধি তালিকায় রাখা হচ্ছে না কেন?

অর্থ দফতরের ব্যাখ্যা: সরকার যাঁদের খরচ বহন করবে, শুধু তাঁদের নামই মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর ‘সরকারি’ তালিকায় থাকছে। এর বাইরে কোনও শিল্পপতি গেলে তিনি রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবেই যাবেন, কিন্তু নিজের খরচে।

লন্ডন সফরের প্রয়োজনীয় খরচের অগ্রিম তোলার অনুমোদন অর্থ দফতর ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে শিল্পোন্নয়ন নিগমকে। নিগম সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরের আয়োজন করেছিল যে সংস্থা, তাদেরই লন্ডন সফরের আয়োজনের জন্য কয়েক কোটি টাকা বরাত দেওয়া হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement